গণ আন্দোলন ও সহিংসতার মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নজিরবিহীনভাবে পুলিশ ছাড়া একটি দিন কাটাল বাংলাদেশ; যেখানে অনেকগুলো থানা ফাঁকা পড়েছিল, আইনশৃঙ্খলা ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কোথাও কাজ করেনি পুলিশ।
আগের দিন সোমবার বিকালের পর থেকেই নগরীতে প্রকাশ্যে পুলিশের সংখ্যা কমতে থাকে; মঙ্গলবার শুধু রাজধানীতে নয় প্রায় পুরো দেশেই পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে দেখা যায়।
ছাত্র-জনতার রাজপথ দখলে নেওয়ার তুমুল আন্দোলনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর থেকেই দেশজুড়ে থানাসহ পুলিশের স্থাপনাগুলোতে একের পর এক হামলা হতে থাকে। নির্বিচারে আক্রমণ হতে থাকে থানায়, ভাঙচুর ও লুটপাটও করা হয় অনেক থানায়।
এসব হামলায় বহুসংখ্যক পুলিশ হতাহত হলে অন্যরা নিরাপদে সরে যেতে থাকেন। এতে করে এমন নজিরবিহীন অবস্থা তৈরি হয়েছ বলে জানিয়েছন পুলিশ কর্মকর্তারা।
মঙ্গলবার বিমানবন্দরসহ স্থলবন্দরগুলোতে ইমিগ্রেশন পুলিশ ছাড়া পুলিশের অন্য ইউনিটগুলোও কার্যকর ছিল না।
জীবন বাঁচাতে আত্মগোপন করেছেন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাসহ বেশিরভাগ সদস্য। যে কারণে মঙ্গলবার সকাল থেকে থানাগুলো ছিল পুলিশ শূন্য ও অরক্ষিত। থানায় ফিরতে জীবনের নিরাপত্তা চাইছেন পুলিশ সদস্যরা। এই দাবিতে কর্মবিরতির ডাকও দিয়েছেন তারা।
ঢাকায় অরক্ষিত হয়ে পড়া অনেক থানায় মঙ্গলবার অবাধে ঢুকে ঘুরিয়ে বেড়িয়েছেন অনেকে। বিভিন্ন কক্ষে থাকা বিভিন্ন জিনিসপত্র থেকে যার যা ইচ্ছে নিয়ে গেছেন যাচ্ছেন।
ঢাকাসহ দেশের যেসব থানায় হামলা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে যেগুলোতে আগুন দেওয়া হয়নি সেগুলো ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
এমন অবস্থার জন্য যাদের কারণে পুলিশের এ অবস্থা তাদের বিষয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দিয়ে ক্ষোভ ও কর্মবিরতির কথা জানিয়েছে পুলিশের নন ক্যাডার কর্মকর্তা ও সদস্যদের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন। ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে নিজেদের ‘বঞ্চিত’ দাবি করা একটি অংশ সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশি ব্যবস্থা দ্রুত ফেরানোর দাবিও তুলেছে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও জনতার ওপর গত ১৪ জুলাই থেকে নির্বিচারে গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। ১৯ ও ২০ জুলাই ঢাকায় পুলিশ আন্দোলনরত মানুষের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে বলে অভিযোগও আসে। এতে বহু মানুষ হতাহতের খবর এসেছে।
দুদিনে ঢাকায় প্রায় দেড়শ তরুণ, শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষের মৃত্যু হয়। এত মানুষের মৃত্যুর পর পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামায়। এর মধ্যেই চলে ব্লক রেইড দিয়ে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার। নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় নেতাকেও।
ঢাকা মহানগর ডিবি কার্যালয়ে তাদের ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ রাখার কথা বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ। তাদের খাইয়ে দাইয়ে সেই ছবি প্রচার করেন তিনি। তাদের ভয় দেখিয়ে বিবৃতি আদায়ের অভিযোগও ওঠে।
দেশব্যাপী অনেক মানুষের মৃত্যুসহ গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের ওপর ব্যাপক ক্ষুব্ধ ছিল সাধারণ মানুষ। যার জের প্রকাশ পায় শেখ হাসিনার পতনের আগের দিনই। রোববার সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় ১৪ পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় জনতা। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবরের পর শুরু হয় দেশব্যাপী থানায় থানায় হামলা।
এখন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে পড়েছেন পুলিশের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সদস্যরা। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা নিরাপত্তা শঙ্কায় পরিবারসহ আত্মীয়-পরিজনদের বাড়ি গিয়ে উঠেছেন। পুলিশের আবাসিক এলাকার বাসা ছেড়েছেন অনেক কর্মকর্তা ও সদস্য।
ঢাকায় পুলিশ সদস্যদের অনেকে বিভিন্ন থানা থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গিয়ে জড়ো হয়েছেন। বিভিন্ন জেলায় পুলিশ সদস্যরা জড়ো হয়ে পুলিশ লাইনে অবস্থান করছেন। কেউ অন্য জায়গায় নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন।
পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে এতদিনে ক্ষোভ ঝাড়তে শুরু করেছে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। পুলিশের এই অবস্থার জন্য শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তাকে দায়ী করছেন তারা।
আবার সোমবার বিকালে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে শীর্ষ কর্মকর্তারা অধঃস্থনদের বিপদের মুখে রেখে হেলিকপ্টারে পালিয়েছেন-ক্ষোভের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছেন কয়েকজন।
এমন অবস্থায় ঊর্ধ্বতনদের ওপর মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের আস্থা ফেরানোর বিষয়টিকেও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ আস্থা না থাকলে পুলিশের চেইন অব কমান্ড থাকবে না বলে জানাচ্ছেন অনেক কর্মকর্তা ও নিচের ধাপের পুলিশ সদস্য।
ক্ষয়ক্ষতি কত?
মঙ্গলবার নিরাপত্তা না থাকার কারণে পুলিশের বেশির ভাগ কর্মকর্তা ও সদস্য আত্মগোপনে থাকায় তারা নিয়মিত কাজ করতে পারেননি। যার ফলে সারা দেশে কত পুলিশ নিহত হল, কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হল তার হিসাব নিরূপণ করা যায়নি।
তবে পুলিশের নন ক্যাডার কর্মকর্তা ও সদস্যদের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সারাদেশে ৪৫০টি থানা আক্রান্ত হয়েছে। সারাদেশে মোট থানার সংখ্যা ৬৫০টির মত।
সোমবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা, ঢাকার আশুলিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ সদস্যদের নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা এবং হত্যার পর ঝুলিয়ে রাখার খবর এসেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা অবনতিতে নিহত পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করার কাজ এখনও শেষ হয়নি। যার কারণে প্রকৃত সংখ্যা জানা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী থেকে পুলিশের আটটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, অন্য জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং উদ্ধারের কাজ চলছে।
এক প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, অনেক পুলিশ সদস্য নিরাপত্তার প্রয়োজনে আত্মগোপনে চলে গেছেন।
“আমরা দ্রুততম সময়ে তাদের কাজে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করছি এবং অরক্ষিত পুলিশ স্থাপনাগুলোকে নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারে কাজ করছি।”
পুলিশ সদস্যরা যেখানে যে অবস্থায় আছেন তাদের নিরাপত্তা প্রশ্নে সেখানকার ইউনিট কমান্ডারদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দেন পুলিশের এ শীর্ষ কর্মকর্তা।
আরেক অতিরিক্ত আইজিপি আতিকুল ইসলাম বলেন, তারা ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। একটি তালিকা করারও প্রস্তুতি চলছে।
ধ্বংসের চিহ্ন থানায়, দপ্তরগুলো ফাঁকা
মঙ্গলবার সকালের পর ঢাকার বাড্ডা, খিলক্ষেত, উত্তরা পূর্ব, পল্টন, মিরপুর, রূপনগরসহ কয়েকটি থানা ঘুরে কেবল ধ্বংসস্তুপই দেখা গেছে। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে যানবাহন, নথিপত্র সব। লুট হয়েছে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, আসবাবপত্রসহ অন্যান্য জিনিসপত্র।
ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপ কমিশনার ফারুক হোসেন বলছেন, ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে বেশির ভাগই আক্রান্ত হয়েছে।
এদিন ঢাকায় পুলিশের প্রধান প্রধান দপ্তরগুলো ঘুরে দেখা গেছে কাজে আসেননি কর্মকর্তারা। বেলা ১১টার দিকে পুলিশ সদর দপ্তরে গিয়ে দেখা গেছে প্রধান ফটকগুলো তালা মারা। ভেতরে সারি সারি গাড়ি এরমধ্যে সামনের কয়েকটি গাড়ির কাচ ভাঙা।
ফটকের গার্ডরুমে বসে আছেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তারা বলেন, সকাল থেকে কোনো কর্মকর্তা দপ্তরে আসেননি।
মালিবাগে এসবি ও সিআইডি অফিসেও ছিল না চিরচেনা ভিড়।
সোমবার রাতে চারদিক থেকে পুলিশের স্থাপনায় জ্বালাও-পোড়াওয়ের খবর আসতে থাকায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন রাজারবাগে থাকা লোকজনও। মধ্যরাতে সাইরেন বাজিয়ে সতর্ক অবস্থান নেওয়ার কথা জানান দেওয়া হয়। সাইরেন বাজানোর এ ভিডিও রাত থেকেই ঘুরছিল ফেইসবুকে। অনেকের মধ্যে তা আতঙ্ক ও গুজব তৈরি করে।
মঙ্গলবার দুপুরে রাজারবাগে গিয়ে দেখা গেছে, প্রধান ফটক আটকানো। অস্ত্র কাঁধে কয়েকজন সদস্য পাহারা দিচ্ছেন। জানতে চাইলে তারা বলেন, “বাঁইচা আছি ভাই। কেউ রাইতে ঘুমায় নাই। এখন আমাগো কী হবে জানি না।”
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে আলোচনার কেন্দ্রে থাকা মিন্টো রোডের ঢাকা মহানগর ডিবি কার্যালয়ও ছিল ফাঁকা। এ কার্যালয়ের সামনে চারজন পুলিশ সদস্যকে বসে থাকতে দেখা গেল। নির্ঘুম রাতের ধকলে তাদের সবার চোখ লাল।
একজন বললেন, “রাতে ঘুমামু কেমনে ভাই। স্যাররা কেউ নাই, সব পালাইছে। চারদিক থেকে সব খারাপ খারাপ খবর আসতেছে। থানায় থানায় হামলা হইছে। এই পর্যন্ত টিকা রইছি এইডাই অনেক।”
ডিবি কার্যালয়ের সামনে স্প্রে রঙ দিয়ে কেউ লিখে দিয়েছে “হারুনের ভাতের হোটেল বন্ধ”।
এই কম্পাউন্ডের ভেতরেই বহুল আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ অফিস করতেন। পরে তাকে ডিএমপির ক্রাইম বিভাগে বদলি করা হয়। তাকে গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়েছে ফেইসবুকে।
এমন খবরের মধ্যে মঙ্গলবার বিকালে হারুন মোবাইল ফোনে বলেন, তিনি ঢাকাতেই আছেন, অফিসে (ডিএমপি সদর দপ্তরে) গিয়েছিলেন কিন্তু কেউ না থাকায় ফিরে এসেছেন।
অপরদিকে সাজানো গোছানো ঝাঁ চকচকে সদর দপ্তরে কোনো লোককেই দেখা গেল না। দু একজন কৌতুহলী মানুষ উঁকি-ঝুঁকি মারছেন। প্রাঙ্গণে পড়ে রয়েছে সারি সারি গাড়ি।
কর্মকর্তারা দপ্তরে না এলেও ফোন ধরছেন। মোবাইল ফোনে যোগযোগ করা হলে এই পরিস্থিতিতে ‘ম্যান ম্যানেজমেন্টের’ বিষয়টি এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানালেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বর্তমান প্রধান (অতিরিক্ত কমিশনার) আশরাফুজ্জামান।
মহানগরের পাশাপাশি আক্রান্ত হয়েছে ঢাকা রেঞ্জের অনেক থানাও। ফাঁকা দেখা গেছে এ রেঞ্জ অফিসও।
সকালে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি আরেক আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, “এই মুহূর্তে অফিস যাওয়ার মত পরিস্থিতি নেই। তবে আমরা সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি।”
ক্ষুব্ধ পুলিশ সদস্যরা
পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর এখন মুখ খুলছেন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। অনেকেই ফেইসবুকে পোস্ট লিখে সেসব ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
পিবিআই’র এসআই সালেহ ইমরান লিখেছেন, “… সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে তারা (পুলিশ সদস্যরা) জনগণের আবেগের প্রতি সমর্থন দিতে সিনিয়রদের অনুরোধ করে। তারপরও রাজনৈতিক গোলামী হাসিল করার জন্য সিনিয়র অফিসাররা কঠোর নির্দেশনা দিয়ে পুলিশকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। তারপর সুযোগ বুঝে শুধু পুলিশ বাদে অন্যরা পাশ কেটে যায়।
”নির্দেশদাতা সিনিয়ররা মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের মৃত্যুর মুখে দাঁড় করিয়ে যার যার মত আত্মগোপনে চলে যায়৷ দয়া করে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের টার্গেট করবেন না৷ এরা হুকুমের গোলাম মাত্র। যারা হুকুম দিয়ে কাজগুলো করিয়েছেন তাদের খুঁজে বের করুন। যদি কোনো পুলিশ অতিউৎসাহী হয়ে কাজ করে থাকে তাকে বিচারের আওতায় আনুন। বাহিনীর সকল সদস্য তাতে সাধুবাদ জানাবে৷”
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. সোহেল রানা লিখেছেন, “দৃশ্যত বাংলাদেশ পুলিশ এখন সম্পূর্ণরূপে নেতৃত্বহীন। অভিযুক্তরা (কর্মকর্তারা) গা ঢাকা দিয়েছে। জুনিয়র কর্মকর্তা ও সদস্যরা দিশেহারা। এরা সবাই নিরীহ সদস্য।”
তিনি লেখেন, “পুলিশের স্থাপনা ও সম্পদ পুলিশের নয় জনগণের। পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় সকল সম্পদ ধ্বংস বা নষ্ট না করার অনুরোধ রইল।”
ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের সামনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ সদস্য বলেন, তারা পুলিশ সদর দপ্তরের বহুতল একটি ভবনে ছিলেন। সোমবার বিকেলে তাদের অরক্ষিত রেখে সদর দপ্তরের ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যান শীর্ষ কর্মকর্তারা। এরপর সোমবার রাত ১১টার দিকে হামলাকারীরা সদর দপ্তরে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলে তারা প্রতিহত করেন। তাদের কয়েকজন পাশের কন্ট্রোল রুমে গিযে আশ্রয় নিলে সেখানেও হামলা-ভাঙচুর চালায় হামলাকারীরা।
ক্ষুব্ধ ওই পুলিশ সদস্য বলেন, “থানাগুলা সব পুড়ায় দিচ্ছিল। আমরা খুবই ভয়ে আছিলাম। আর আমাদের কুনো নির্দেশ, পরিকল্পনা কিছুই না দিয়া স্যাররা পালায় গেল।”
তবে শেষতক পুলিশ সদর দপ্তরের ভেতরে হামলাকারীরা ঢুকতে পারেনি বলে ওই সদস্য জানান। শুধু বাইরে থেকে ঢিল মেরে কিছু যানবাহনের কাঁচ ভেঙেছে। পরে তাদের অনেকেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আশ্রয় নেন, তিনি ভাইয়ের বাসায় যান। তার ভাইও পুলিশে চাকরি করেন।
মিন্টো রোডে মিডিয়া সেন্টারের সামনে ডিবির একজন এসআই চিৎকার করে বলছিলেন, “হারুন কখনও আমাদের খোঁজ নেয় নাই। আমরা কি খাই কেমনে থাকি কোনদিন খোঁজ নেয় নাই। অথচ নায়িকারা আইলে ও শেরাটন (ইন্টারকন্টিনেন্টাল) থেকে খাবার আনায়।”
কর্মবিরতির সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
এসব হামলা ও হত্যার পর পুলিশের কর্মকর্তারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না দেওয়া পর্যন্ত কাজে না ফেরার কথা বলছেন। ফেইসবুকে পুলিশের রক্তাক্ত ক্যাপের ছবি দিয়ে প্রতিবাদ করছেন কর্মকর্তা ও সদস্যরা।
পুলিশের কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পর্যন্ত কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের মঙ্গলবার পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তারা না চাইলেও তাদের দিয়ে জোর করে আন্দোলনরত মানুষের ওপর গুলি করানো হয়েছে। তারা এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। এখন কোটা সংস্কারের মতো পুলিশের সংস্কারের কথা বলছেন তারা।
ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “পুলিশের কোনো সদস্য অন্যায় করলে অবশ্যই তার বিচার হতে হবে। দেশের এই সুসময়ে আমরা আপনাদের কাছে থানা-ফাঁড়ি ও পুলিশি স্থাপনার নিরাপত্তা চাই। পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা চাই। গত সোমবার সারা দেশে ৪৫০ এর বেশি থানা-ফাঁড়ি আক্রান্ত হয়েছে।
” প্রতিটি পুলিশ সদস্যের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কর্মবিরতি ঘোষণা করছি। আমরা বৈষম্যহীন পুলিশ বাহিনী চাই। পুলিশের সংস্কার চাই। পুলিশ কোনভাবেই এখন দেশের মানুষের সাথে বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্কে জড়াতে চাই না। পুলিশ বাহিনীর সদস্য হিসেবে নিরীহ ছাত্রদের ওপর যে অন্যায় করা হয়েছে সেজন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।”
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “নিয়োগের শুরু থেকেই সাব ইন্সপেক্টর বা সার্জেন্টরা তাদের ঊর্ধ্বতনদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের বাহক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হন। বৈধ বা অবৈধ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যেকোন আদেশ পালন করতে বাধ্য হন তারা। তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ যেকোন আন্দোলনে সাধারণ মানুষকে সরাসরি গুলি করতে না চাইলেও সেটা করতে বাধ্য করা হয় দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য। তারা দেশবাসীর কাছে পুলিশ সদস্যদের ভিলেইনে পরিণত করেছেন।”
তবে কর্মবিরতির বিষয়টিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি শহিদুর রহমান।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলছেন, কর্মবিরতি নিয়ে যে প্রচারণা চলছে তা নিছক গুজব বলে তাতে কান না দেওয়ার দরকার নেই।
“পুলিশ ছাড়া সমাজে কোন কিছু চিন্তা করা যায় না। এখন অতীত সব ভুলে পুলিশকে সহায়তার জন্য ছাত্র জনতা রাজনীতিবিদদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।”
আইজিপির ভিডিওবার্তা
মঙ্গলবার অজ্ঞাত স্থান থেকে সোয়া ২ মিনিটের এক ভিডিওবার্তায় পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন পুলিশের স্থাপনায় হামলা বন্ধের অনুরোধ করেন। তবে এর কয়েকঘণ্টা পর তাকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়।
ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, “পুলিশের সদস্য ও পুলিশের স্থাপনা সমূহে যাতে আক্রমের ঘটনা সংঘটিত না হয় এজন্য বিনীত অনুরোধ করছি।
“সেই সাথে পুলিশের স্থাপনা সমূহের নিরাপত্তা, পুলিশের নিরাপত্তা নিশ্চিত কল্পে দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনী অহর্নিশ সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।”
আইজিপি বদল
মধ্যরাতে শেখ হাসিনার নিয়োগ দেওয়া আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ মামুনকে চাকরি থেকে বাদ দিয়ে একজন নতুন আইজিপির নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুলের কমান্ড্যান্ট মো. ময়নুল ইসলাম এখন থেকে পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ মামুনের অবসরে যাওয়ার কথা ছিল দেড় বছর আগেই। তারপরও তাকে চুক্তিতে আইজিপি করে রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ গত ৫ জুলাই আরো এক বছরের জন্য তার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। মঙ্গলবার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেই চুক্তি বাতিল করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
গণ আন্দোলনে ক্ষমতার পালাবদলের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন ভেঙে পড়েছে, ঠিক তখন মামুনকে সরিয়ে পুলিশের শীর্ষ পদে এই পরিবর্তন আনা হল।
৫৮ বছর বয়সী ময়নুল ইসলাম পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৯১ সালের ১ জানুয়ারি। এক সময় তিনি র্যাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
সংখ্যাতিরিক্ত অতিরিক্ত পুলিশ মহা পরিদর্শক থেকে মহা পরিদর্শকের দায়িত্ব পাওয়া ময়নুল ইসলামের স্বাভাবিক অবসরের বয়সে পৌঁছাতে বাকি আছে আর আট মাস।
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বেশ কয়েকজন অতিরিক্ত আইজিপিকে ডিঙিয়ে ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুলের কমান্ড্যান্ট ময়নুলকে পুলিশের নেতৃত্বে আনা হলেও সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে জ্যেষ্ঠতার বিবেচনায় তিনি অনেকের চেয়ে এগিয়েই ছিলেন।
থানার নিরাপত্তায় আনসার
অরক্ষিত হয়ে পড়া থানাগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীকে।
পাশাপাশি ঢাকা মহানগরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বেও থাকবে এই বাহিনী। আনসারের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
আনসার ভিডিপির সহকারী পরিচালক রুবেল হোসেইন বলেন, আনসার সদস্যরা থানাগুলোর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধান করবে। পাশাপাশি ঢাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বেও তাদের মোতায়েন করা হচ্ছে। সূত্র: বিডিনিউজ
চস/স