শিপন ও ইউসুফ দুইজনে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। মধ্যবিত্ত পরিবারে অভাব এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আর সেই অভাবের সংসারের সাথে তাল মিলিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে শিপন ও ইউসুফ। ছোটকাল থেকে তাদের পড়াশোনায় বেশ আগ্রহ। বলতে গেলে দুইজনই প্রচন্ড মেধাবী ছাত্র। সব সময় নতুন কিছু জানার জন্য আগ্রহের সাথে শিখতে চেষ্টা করে। শিপনের ইচ্ছে পড়াশোনা শেষ করে দেশের একজন বড় অফিসার হবে। পরিবারের খুঁটি উন্নতি করবে। ঠিক তেমনি ইউসুফের ইচ্ছে পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটা চাকরি করবে। অসহায় পরিবারের দুর্বল খুঁটিকে আরো বেশি শক্তিশালী করবে, পরিবারের অভাব দূর করে ঘর আলোকিত করবে। শিপন ও ইউসুফের কথাগুলো কাল্পনিক হলেও তাদের মত এদেশে আরো লাখো শিক্ষার্থীর বাস্তব জীবনে স্বপ্ন এমনই। কিন্তু যখন তারা পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পরীক্ষায় যায় তখন সেই স্বপ্ন নিমিষেই ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। কারণ, আমাদের দেশে চাকরির পরীক্ষায় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের মত নিকৃষ্ট কাজের অভিযোগ পাওয়া যায়। আর যখন এসব নিকৃষ্ট কাজে জাতির আলোকবর্তিকারা অর্থাৎ শিক্ষক সমাজ জড়িত থাকে তখন এ জাতির কাছে আশার বাণী শোনা বড় দায়। কেননা, সম্প্রতি আমাদের দেশের কিছু শিক্ষকরা বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পুরো শিক্ষক সমাজ ব্যবস্থা। তাদের নীতি নৈতিকতা অবক্ষয়ের কারণে আজ শিক্ষক সমাজ ব্যবস্থায় অন্ধকারের ছায়া নেমে এসেছে। কলুষিত হচ্ছে মহান পেশার অতীতের গৌরব ও মর্যাদার। সবার মুখে মুখে তাদের প্রতি ধিক্কার প্রতিবাদের সুর। কিন্তু দিনশেষে কোন আশার বাণী শোনা যায় না বরং চাকরি প্রত্যাশীদের অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে না পারায়।
চাকরি প্রত্যাশীদের এমন আরো বহু অসহায়ত্বের কথা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, স্থায়ীভাবে চাকরির পরীক্ষায় প্রবেশসীমা বা বয়স বৃদ্ধি না করা। কোভিড-১৯ বা বিশ্ব মহামারি করোনা ভাইরাস চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য এক অভিশাপ। কারণ করোনায় পৃথিবীর সবকিছু থমকে গিয়েছিল। বাংলাদেশেও এই ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তবে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। কারণ, করোনায় শিক্ষার্থীদের প্রায় দুই বছর সময় শিক্ষা জীবন থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে, প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা তাদের মৌলিক পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাদের এমন ধাক্কা কীভাবে পুষিয়ে উঠবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেই সাথে চাকরি প্রত্যাশীদেরও অবস্থা বেহাল দশা। করোনা ভাইরাসের চলাকালীন সময়ে অনেকের চাকরির আবেদনের বয়সসীমা শেষ হয়ে গেছে। আবার অনেকেরই কাছাকাছি বয়স ছিল। আর এই সময়টার ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকার “ব্যাকডেট” নামক পদ্ধতি চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। যা শুধুমাত্র ঐ সময়কার চাকরি প্রত্যাশীরা ভোগ করবে কিন্তু উচিত ছিল এই পদ্ধতিটা স্থায়ীভাবে সর্বজনীন করা। যাতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সময় টা ফিরে পেতে পারে। আমাদের দেশের বর্তমান চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে যখন গড় আয়ু ছিল ৫৫ বছর তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ আর অবসরের বয়স ছিল ৫৭ বছর। ১৯৯১ সালে সেশনজটের পরিস্থিতি বিবেচনা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ২৭ এর পরিবর্তে করা হলো ৩০ বছর। আর তখন ১৯৯১ সালে গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। এরপর ২০১১ সালে এসে অবসরের বয়স বেড়ে হয় ৫৯ আর মহান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হয় ৬০। অবসরের এই ২-৩ বছর বাড়ার কারণে এই সময় তেমন চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি। ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই ৩০ বছরে গড় আয়ু ১৬ বছর বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশসীমার বয়স বাড়েনি। ঠিক আগের অবস্থানে বহাল রয়েছে। এক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় উপলব্ধি করা যায়। আর সেটি হচ্ছে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কারণ, চিকিৎসকদের শিক্ষাজীবন বেশি দিনের হওয়ার কারণে তাদের আবেদনের বয়সসীমা ৩২ বছর করা হয়েছে। কোটায় আওতাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্যও চাকরির বয়সসীমাও ৩২ বছর। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সম্মান কোর্স তিন বছরের স্থলে চার বছর করা হলেও চাকরিতে আবেদনের প্রবেশকালীন সময় বৃদ্ধি করা হয়নি। তাহলে কি এমন পদক্ষেপ গ্রহণে আমরা বৈষম্যের শিকার বলতে পারিনা? সেটি নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
আমাদের দেশে এমনিতেও বেকারত্বের হার অনেক বেশি। একটি দেশের জন্য বেকারত্ব হচ্ছে হুমকিস্বরূপ বা অভিশাপ। কারণ এই বেকারত্ব দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বা সার্বিক উন্নয়নের পথে ধাবিত হওয়ার জন্য বড় একটি বাধা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেকার। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১১ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এই হার ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। শিক্ষিতদের মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ। যার মধ্যে শিক্ষিত তরুণ বেকারের সংখ্যাই বেশি। আর শিক্ষিত বেকার হওয়ার পিছনে একটি কারণ হচ্ছে চাকরির বয়সসীমা পার হয়ে যাওয়া।
আমরা যদি অন্যান্য দেশগুলোর চাকরির প্রবেশের বয়সসীমা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে আমাদের দেশের চাকরির বয়সসীমা ৩০ বছরের থেকে তাদের প্রবেশসীমা উর্ধ্বে। বিশ্বের ১৯২টি দেশের মধ্যে ১৫৫টি দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৫৫ বছর। আবার কোথাও কোথাও ৫৯ বছর পর্যন্ত। উত্তর আমেরিকাতে ৫৯ বছরেও একজন নাগরিক সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেন। শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়াতে সরকারি চাকরি প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৪৫। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও চাকরির ক্ষেত্রে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর। পৃথিবীর যত উন্নয়নশীল দেশ রয়েছে, প্রত্যেক রাষ্ট্র্র বা দেশে চাকরির বয়সসীমা ৩০ ঊর্ধ্বে হওয়ার কারণেই তারা এত উন্নত। তাহলে অন্যান্য দেশগুলোর থেকে আমরা কেন চাকরির বয়সসীমার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকব? সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
চাকরি প্রত্যাশীদের মুখে নানা ধরনের অসহায়ত্বের বাণী শোনা যায়। কিন্তু কে শুনবে তাদের কথা, কে ভাববে তাদের নিয়ে? তাদের অসহায়ত্বের বাণীর মধ্যে অন্যতম আরো একটি হলো, চাকরি পরীক্ষার আবেদন ফি কমানো। চাকরি প্রত্যাশীদের মধ্যে অধিকাংশই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কেউ কেউ টিউশনি কিংবা পার্ট টাইম জব করে নিজেদের পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছে। কিন্তু এত বেশি ফি’র কারণে তারা চাকরি পরীক্ষার আবেদন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবুও এত কষ্টের মধ্যেও চাকরি পরীক্ষায় আবেদন করেও শান্তি নেই, আশার আলো নেই। কারণ একই সময়ে বিভিন্ন পদের বা মন্ত্রণালয়ের চাকরি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করছে। ফলশ্রুতিতে, তারা সব পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছে না এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের দেশে স্থায়ীভাবে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ এর উর্দ্ধে করাসহ বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে চাকরি প্রত্যাশীরা আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। বরং শুধু মাত্র আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে।
তাই সরকারের উচিত হবে, স্থায়ীভাবে চাকরি প্রত্যাশীর বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে অন্তত দুই বছর বাড়িয়ে ৩২ বছর করা এবং কেবল করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রার্থীদের কথা ভেবে “ব্যাকডেট” নামক পদ্ধতিতে বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত না করে সর্বজনীনভাবে করে দেয়া। চাকরির পরীক্ষায় কোন ধরণের অনিয়ম-দুর্নীতি যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সরকারের আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর সহ সঠিক ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। চাকরির আবেদন ফি কমিয়ে যেন চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য সহনশীল হয় এমন কিছুর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি একই সময়ে বিভিন্ন পদের পরীক্ষা যেন না হয় এবং বেকারত্ব হ্রাস করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশে আরো বেশি আত্মকর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। এতে চাকরি প্রত্যাশীরা নিজ কর্মসংস্থানে যুক্ত হওয়ার ফলে দেশ উন্নতির শিখরে দুর্বার গতিতে পৌঁছাতে পারবে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে। নয়তো শিক্ষার মান উন্নয়নের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে পড়বে। তাই জাতীয় স্বার্থে, বেকার মুক্ত দেশ গড়তে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মেধাকে মূল্যায়ন করতে শিপন ও ইউসুফের মতো লাখো চাকরি প্রত্যাশীদের অসহায়ত্বের কথা গুলো শুনে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই সম্ভব হবে চাকরি প্রত্যাশীদের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করা।
মু, সায়েম আহমাদ
শিক্ষার্থী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
ঢাকা কলেজ, ঢাকা