spot_img

১৬ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, বৃহস্পতিবার
৩০শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সর্বশেষ

একুশ মানে মাথা নত না করা

কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতায় লিখেছেন, “স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো চারকোটি পরিবার- খাড়া রয়েছে তো- যে ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য পারেনি ভাঙতে।” আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে বাঙালির গর্বের অন্ত নেই। কিসের ভয়, সাহস প্রাণ….. একুশ মানে মাথানত না করা। মায়ের মুখের ভাষা বাংলাকে আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে বীর সন্তানেরা ১৯৫২ সালের এই মাসে গড়ে তুলেছিলেন এক অগ্নিঝরা আন্দোলন। বুকের তাজা রক্তে রাজপথ ভাসিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভাষার অধিকার।বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন একাধারে যেমন ছিলো রাষ্ট্রীয় জীবনে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, তেমনি এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার জাতিস্বত্বা ও আপন সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রতিও সচেষ্ট হয়ে উঠেছিলো।
মহান ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। যে কারণে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে অনন্য প্রেরণার উৎস। ভাষার মাসেই দেশের সর্বত্র বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে থাকে উৎসবমুখর। সৃজনশীল ও উদ্দীপনাময় আমেজ বিরাজ করে সর্বত্রই। এখানেই শেষ নয়, এখন আন্তর্জাতিক ভাবেও দিবসটি পালন করা হয় বেশ সাড়ম্বরেই। এছাড়া বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাঙালিরা নিজ ভাষার মর্যাদায় আয়োজন করে থাকে নানা অনুষ্ঠানের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ এখন মুখরিত নানা উৎসবের আয়োজনে। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাঙালি সন্তানেরা যে আন্দোলন করে তা শুধু মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য করেনি। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পাশাপাশি বাঙালি জাতির সংস্কৃতি রক্ষাও ছিলো রফিক, সালাম, বরকতের উদ্দেশ্য।

শামসুর রাহমান ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ কবিতায় লিখেছেন “বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও/ আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ/ বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে/ সালামের মুখ আজ উন্মচিত মেঘনা/ সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা/ সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।” এ কবিতার মধ্যে ৫২’ এর ভাষা আন্দোলনই যে স্বাধীনতার প্রেরণা তা বুঝতে কারোরই সংশয় নেই।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন মুষ্টিমেয় ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীর আন্দোলন নয়। তা শুধু শিক্ষাগত অথবা সাংস্কৃতিক আন্দোলনই ছিলোনা। বস্তুতপক্ষে তা ছিলো পূর্ব বাংলার উপর সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার পাকিস্তানি শাসক ও শোষক শ্রেণির জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি বিরাট ও ব্যাপক আন্দোলন।১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে যারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাদের অমলিন স্মৃতি স্মরণের মাস ফেব্রুয়ারি।

“উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রেভাষা” পাকিস্তান সরকারের এমন ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলা ভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়। জাগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ পাকিস্তান সরকারের আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। তাই বাংলা ভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে, ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে নিহত হন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকসহ নাম না জানা আরো অনেকে। এরপর পথ পরিক্রমায় রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পায় মার্তৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। সেই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরে নয় মাসব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধ।পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ভাষার জন্য বাংলার দামাল সন্তানদের আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। ঐদিন ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। এরই মধ্য দিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস হিসেবে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়। কেননা পৃথিবীর একমাত্র জাতি হিসেবে বাঙালিরাই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলো।

মোছা. জান্নাতুল ফেরদৌস শ্রাবণী
শিক্ষার্থী, উর্দু বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Latest Posts

spot_imgspot_img

Don't Miss