spot_img

১৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, বুধবার
২৯শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সর্বশেষ

যে কারণে চুক্তি ভেঙে ইউরেনিয়ামের মজুত বাড়িয়েছে ইরান

পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে হওয়া সমঝোতা থেকে আংশিক সরে এসে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত বাড়িয়েছে ইরান। ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই স্বাক্ষরিত ওই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, তেহরান তার স্পর্শকাতর পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করবে। অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেওয়ার বিনিময়ে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের দেশে ঢুকতে দেবে। তবে ওই চুক্তি বা সমঝোতার চার বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ১ জুলাই চুক্তি থেকে আংশিক সরে আসার ঘোষণা দেয় তেহরান। চুক্তি ভেঙে ইউরেনিয়ামের মজুত বাড়ানোর ঘোষণা দেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ।
এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে জানতে হবে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম আসলে কী? বস্তুত দুনিয়াজুড়ে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বা ইউরেনিয়ামের মজুত বাড়ানো হয় শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, যেমন চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে বা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু এটি যদি অত্যধিক পরিশোধিত হয়, তাহলে সেই ইউরেনিয়াম দিয়ে পারমাণবিক বোমা বানানো যায়। পারমাণবিক চুক্তি অনুযায়ী, ২০৩১ সাল পর্যন্ত ইরানকে কেবল কম সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যার মাত্রা হবে তিন থেকে চার শতাংশ। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য যে ইউরেনিয়াম লাগে, তার মাত্রা ৯০ শতাংশ বা তার বেশি। চুক্তি অনুযায়ী, তেহরান ৩০০ কেজির বেশি কম সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রাখতে পারবে না। এছাড়া ইরান ১৩০ টনের বেশি ভারী পানি, যার মধ্যে সাধারণ পানির চেয়ে বেশি হাইড্রোজেন থাকে তা সংরক্ষণ করতে পারবে না। সেই সঙ্গে বিশেষায়িত পানির মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের নকশা নতুন করে করতে হবে। বিশেষায়িত পানির রিঅ্যাক্টরে প্লুটোনিয়াম থাকে, যা পারমাণবিক বোমায় ব্যবহার করা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রকে পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে চুক্তি ভেঙেছে ইরান?
২০১৮ সালের মে মাসে পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং নতুন করে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ট্রাম্পের ভাষ্যমতে, চুক্তিতে অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে। তিনি চেয়েছিলেন ইরানকে নতুন চুক্তিতে বাধ্য করতে। কিন্তু তেহরান তাতে রাজি হয়নি। তবে ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের ফলে ইরানের অর্থনীতির ওপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলেও তার ইউরোপীয় মিত্র যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি ইরানের সঙ্গে চুক্তি অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। ইরান যেন চুক্তি থেকে সরে না আসে সেজন্য ইউরোপীয় দেশগুলো তেহরানের প্রতি ক্রমাগত আহ্বান জানিয়ে আসছিল। কিন্তু একের পর এক মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং অতি সম্প্রতি উপসাগরীয় এলাকায় মার্কিন সামরিক তৎপরতার ফলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ১ জুলাই সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুতের সীমা বাড়ানোর ঘোষণা দেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ইরানি মন্ত্রীর ঘোষণা ২০১৫ সালে চুক্তির লঙ্ঘন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, তেহরান যদি এ ধরনের আরও পদক্ষেপ নেয় তাহলে তা পুরো চুক্তিকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে। যুক্তরাজ্য ও জার্মানির পক্ষ থেকেও ইরানকে ইউরেনিয়াম মজুতের সীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা দেশটির ওপর ‘সর্বোচ্চ চাপ’ প্রয়োগের কৌশল অব্যাহত রাখবে। এখন আন্তর্জাতিক আণবিক সংস্থা আইএইএ যদি একে চুক্তির লঙ্ঘন বলে ঘোষণা করে, তাহলে জাতিসংঘ এবং বৃহৎ শক্তিগুলো ইরানের ওপর আরও অবরোধ আরোপ করতে পারে। বৃহৎ শক্তিগুলো যদি এ নিয়ে কোনও ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে ইরান চুক্তির আরও লঙ্ঘন করতে পারে। ইতোমধ্যে তেহরানের দিক থেকে এমন ইঙ্গিত স্পষ্ট। এখন, ইরানের পক্ষ থেকে চুক্তির শর্ত ভাঙ্গার এই খবরের পর পারমাণবিক চুক্তিটির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হবে।
কী করেছে ইরান?
পারমাণবিক বোমা তৈরি থেকে তেহরানকে বিরত রাখতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উদ্যোগে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে ছয়টি শক্তিধর পশ্চিমা দেশের একটি চুক্তি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ইরান তাদের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত একটি বেঁধে দেওয়া সীমার মধ্যে রাখবে। বিনিময়ে দেশটির ওপর থেকে অধিকাংশ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসার পর খোলাখুলি এই চুক্তির বিরোধিতা শুরু করেন। গত বছর তিনি একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান। শুধু চুক্তি থেকেই বেরিয়ে গিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং ইরানের ওপর নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরু করেন।
এখন জানা যাচ্ছে, পারমাণবিক চুক্তিতে বেঁধে দেওয়া সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুতের সীমা লঙ্ঘন করেছে ইরান। ২০১৫ সালে চুক্তিতে মজুতের সর্বোচ্চ সীমা ছিল ২০২ দশমিক আট কিলোগ্রাম। আন্তর্জাতিক আণবিক সংস্থা আইএইএ সোমবার তাদের সর্বশেষ পরিদর্শনে দেখেছে, ইরানের কাছে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ছিল ২০০ কিলোগ্রাম। কিন্তু ইরানের সূত্রে জানা গেছে, ইউরেনিয়ামের মজুত ৩০০ কিলোগ্রাম ছাড়িয়ে গেছে। শুক্রবার ভিয়েনাতে এক বৈঠকের পর ইরানের পক্ষ থেকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব প্রশমনে ইউরোপীয় দেশগুলোর উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। সোমবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেন, ‘চাপের কাছে ইরান কখনোই নতি স্বীকার করবে না। যুক্তরাষ্ট্র যদি কথা বলতে চায়, তাহলে হুমকি ধামকি বন্ধ করে, সম্মান করে কথা বলতে বলতে হবে।’
দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষোভ থেকেই চুক্তি থেকে আংশিক সরে এসে ইউরেনিয়ামের মজুত বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে তেহরান। শুধু পরমাণু চুক্তি থেকে ট্রাম্পের সরে যাওয়াই নয়; বরং হোয়াইট হাউসের অন্যান্য পদক্ষেপও ক্ষুব্ধ করেছে তেহরানকে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্বাস মুসাভি-র ভাষায়, ট্রাম্প প্রশাসন আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতিষ্ঠিত পন্থা ধ্বংস করে দিচ্ছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফের ওপর অবরোধের ফলে মার্কিনিদের সঙ্গে কূটনীতির পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স।

Latest Posts

spot_imgspot_img

Don't Miss