লিবিয়ায় অভিবাসীদের একটি বন্দিশিবিরে বিমান হামলায় অন্তত ৪০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৮০ জন। আহতদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ফলে নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চালানো এ হামলায় হতাহতদের বেশিরভাগই আফ্রিকান অভিবাসী।
জরুরি সেবা বিভাগের মুখপাত্র ওসামা আলি জানান, হামলার সময় তাজুরা বন্দিশিবিরে ১২০ জন অভিবাসী একটি হ্যাঙ্গারে অবস্থান করছিলেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ডা. খালিদ বিন আত্তিয়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসকে তিনি বলেন, প্রায় সব জায়গায় মানুষ ছিল। শিবিরটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যেখানে সেখানে মানুষ কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। অনেকেই মানসিক আঘাতে হতবিহবল হয়ে গেছেন। আমরা পুরো এলাকা পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স আসার পর যা দেখলাম তা ছিল রীতিমতো ভয়ঙ্কর। রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। মানুষের শরীরের টুকরোও পড়ে থাকতে দেখেছি।
বন্দিশিবিরটি রাজধানী ত্রিপোলির কাছে তাজোরা এলাকায় অবস্থিত। সেখানে এ হামলার জন্য জেনারেল খলিফা হাফতারের নেতৃত্বাধীন স্বঘোষিত লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে দায়ী করেছে লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার। এ সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সেরা। তিনি বলেন, হাফতার বাহিনী যা করেছে তা জঘন্য অপরাধ, পূর্বপরিকল্পিত ও নিখুঁত।
হামলার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে হাফতার বাহিনী অবশ্য দাবি করেছে, যে এলাকায় হামলাটি হয়েছে সেখানে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে তারা। বন্দিশিবিরের কাছে সরকারের একটি শিবির লক্ষ্য করে তারা বিমান হামলা চালিয়েছে। জবাবে পাল্টা শেল ছোড়ে সরকারি বাহিনী। ওই শেলগুলোর একটি দুর্ঘটনাবশত অভিবাসী বন্দিশিবিরে আঘাত করে। এর আগে অবশ্য সোমবার হাফতার বাহিনী ঘোষণা দিয়েছিল, প্রচলিত যুদ্ধের সব কৌশল ব্যর্থ হওয়ায় ত্রিপোলির বিভিন্ন স্থানে বিমান হামলা চালাবে তারা।
লিবিয়ায় যুদ্ধ কেন চলছে?
কোনও কর্তৃপক্ষই লিবিয়ার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। চরমভাবে অস্থিতিশীল দেশটির নিয়ন্ত্রণ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক এবং সামরিক গোষ্ঠীর হাতে। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে একটি প্রধানমন্ত্রীর সারাজের নেতৃত্বাধীন এবং অপরটি জেনারেল হাফতারের নিয়ন্ত্রণাধীন। গত এপ্রিলে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে জেনারেল হাফতার। গত চার দশক ধরে লিবিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন জেনারেল হাফতার। ১৯৮০-র দশকে মতবিরোধের জেরে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনের আগ পর্যন্ত গাদ্দাফির কাছের মিত্র ছিলেন তিনি। ২০১১ সালের আন্দোলনের পর দেশে ফিরে পূর্বাঞ্চলে নিজের শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলেন। সমর্থন পান ফ্রান্স, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের। গাদ্দাফি সংশ্লিষ্টতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় তার প্রতি মানুষের মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তবে বেনগাজি এবং এর আশপাশের এলাকাগুলো থেকে কথিত ইসলামপন্থী জঙ্গিদের বিতাড়িত করায় অনেকে তাকে কৃতিত্ব দেন।
লিবিয়ায় অভিবাসীরা কতটা অসহায়?
সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধ পথে ইউরোপ যাওয়ার জন্য অভিবাসীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে লিবিয়া। অভিবাসীদের আশ্রয়কেন্দ্রে বিমান হামলাকে চরম উদ্বেগজনক আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা। ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে অনেক বিদেশিকে নিয়ে লিবিয়ায় অবর্ণনীয় অবস্থার মধ্যে আটকে রাখে দালালচক্র। তারপর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের ঠেলে দেওয়া হয় উত্তাল সমুদ্রে। বহু অভিবাসী দেশটি থেকে ইউরোপের উদ্দেশে সমুদ্রপথে যাত্রা করে মারা গেছেন। সম্প্রতি এমন দুটি ঘটনা ঘটেছে তিউনিসিয়া উপকূলের কাছে।
২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে নিহত হন লিবিয়ার দীর্ঘ সময়ের শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তখন থেকেই দেশটিতে সহিংসতা ও বিভক্তি চরম আকার ধারণ করে। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগে সেখানে মানবপাচারকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। আফ্রিকা অঞ্চলের অভিবাসীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। লিবিয়ার কোস্টগার্ডের হাতে আটক ইউরোপগামী অভিবাসীদের বন্দিশিবিরগুলোর করুণ চিত্র বারবারই তুলে ধরেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।