spot_img

২৬শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, শনিবার
১১ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সর্বশেষ

রোমাঞ্চের বর্ণিল রংয়ে ইংল্যান্ডের শিরোপা উৎসব

নখ কামড়ানো উত্তেজনা, ক্ষণে ক্ষণে রুপ পাল্টানো ম্যাচে বেন স্টোকসের অতি মানবীয় এক ইনিংসের কল্যানে শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ সোনালি ট্রফির স্বাদ পেলো স্বাগতিক ইংল্যান্ড। রোমাঞ্চের কত রঙ থাকে? উত্তেজনার কত রূপ! ক্রিকেট তার অনিশ্চয়তা আর সৌন্দর্যের সবটুকু মেলে ধরল লর্ডসের ফাইনালে। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের ভাগ্য বদল হলো অসংখ্যবার। শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ টাই হয়ে গড়াল সুপার ওভারে। সেখানেও রোমাঞ্চের তীব্র দুলুনি শেষে আবার টাই! শেষ পর্যন্ত দুই দলকে আলাদা করল বাউন্ডারি সংখ্যা। অবিশ্বাস্য নাটকীয়তার পর বিশ্বকাপ জয়ের অনির্বচনীয় স্বাদ পেল ইংল্যান্ড। মজার ব্যাপার হলো, মাঠের লড়াইয়ে কেউ কাউকে হারাতে পারেনি। ইংল্যা-ের ভাগ্যে বিধাতা ট্রফিটি এঁকে দিয়েছেন পুরো দিনে বেশি বাউ-ারির সুবাদে!

মূল ম্যাচের নির্ধারিত ১০০ ওভারের খেলায় পিছিয়ে ছিলো না কেউই। নিউজিল্যান্ড ২৪১, ইংল্যা-ও ঠিক তাই। ফলে বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টাই হয় ফাইনাল ম্যাচ এবং শিরোপা নির্ধারণের জন্য ম্যাচ নেয়া হয় সুপার ওভারে। সেখানেও বেন স্টোকস, সাথে জস বাটলার। দু’জনের ১৫ রানের সুবাদে নিউজিল্যান্ডের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৬ রান। স্বাগতিক পেসার জফরা আর্চার তার ক্রিকেটীয় ‘শিশু’ ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় চাপের একটি ওভারে জিমি নিশাম ও মার্টিন গাটলিকে সেই ১৫ রানে আটকে রাখলে সুপার ওভারও দেখে ফেলে টাই। মূল ম্যাচে বেশি বাউন্ডারি হাঁকানোয় প্রথমবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড। বিস্ময় আর রোমাঞ্চে ভরা এক ফাইনাল উপহার দিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলো ইংল্যান্ড।
১৯৭৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ১৯৮৭ সালে অস্ট্রেলিয়া আর ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের কাছে ফাইনালের ব্যর্থতা ভুলিয়ে দিলো ইংল্যান্ড। মাইক ব্রিয়ারলি, মাইক গ্যাটিং ও গ্রাহাম গুচদের আক্ষেপ ঘুচালেন এউইন মরগান। গত বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে বিদায় নেওয়ার পর থেকে যে উত্থান, তারই পুরস্কার তারা পেলো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে। দলকে শীর্ষ র‌্যাংকিংয়ে নেওয়া অধিনায়কের হাতেই উঠলো বিশ্বকাপ ট্রফি। ফেভারিট হিসেবে বিশ্বকাপ শুরু করেছিল ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় ম্যাচে পাকিস্তানের কাছে হারলেও স্কোরবোর্ডে দাপট ছিল তাদের শুরু থেকে। কিন্তু হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেলে তারা। শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার কাছে হার খাদের কিনারায় রেখেছিল তাদের। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভারত ও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ২৭ বছর পর নিশ্চিত করে সেমিফাইনাল, যেখানে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অজিদের উড়িয়ে দিয়ে জায়গা করে নেয় চতুর্থ ফাইনালে। লর্ডস প্রস্তুত ছিল নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে বরণ করে নিতে। শেষ পর্যন্ত ঘরের ছেলেরাই ট্রফি হাতে উদযাপন করলো নিজেদের ব্যালকনিতে।
লর্ডসে গতকালের ফাইনালে ইংল্যান্ডের হাতে শিরোপা উঠেছে মুলত বেন স্টোকসের ব্যাটে ভর করে। তার মাঝে অনেকেই কিংবদন্তি ইয়াম বোথামের ছায়া দেখতে পান। অনেকে তো আগ বাড়িয়ে তার মাঝে বিশ্বের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের প্রতিচ্ছবিও দেখেন। তবে কারো কথাই যে মিথ্যা নয় ম্যাচের পর ম্যাচ সেটাই দেখিয়েছেন ইংলিশ অলরাউন্ডার। গতকাল ইতি ঘটা বিশ্বকাপে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান বেন স্টোকসের। ব্যাট হাতে ৪৬৫ রান ও বল হাতে ৭ উইকেট নিয়ে ইংলিশদের বিশ্বকাপ জয়ের আসল নায়ক তো এই অলরাউন্ডারই। ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপে রীতিমতো বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন বেন স্টোকস। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইংল্যান্ডকে জেতানোর নায়ক তিনি। গ্রুপ পর্বে শ্রীলংকা ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হারলেও সেই দুটি ম্যাচে স্টোকসের প্রতিরোধ সবার নজর কেড়েছে। ভারতের বিপক্ষে শেষের দিক ঝড় স্টোকস ঝড় না তুললে ইংল্যান্ড কি জিততে পারত? আর সেই ম্যাচটা না জিতলে সেমিফাইনাল্ তো উঠতে পারত না ইংল্যান্ড। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ফাইনালে ৮৬ রানে ৪ উইকেট হারানো ইংল্যান্ডের আশার পালে হাওয়া যোগানোর কাজটি তো স্টোকসই করেছেন। শুরুর দিকে ধীরে খেললেও সময় গড়ার সঙ্গে নিজের রূপ দেখিয়েছেন এই অলরাউন্ডার। জস বাটলার ফিরে গেলেও নিজেকে ধরে রাখেন স্টোকস। তবে শেষ পর্যন্ত একাই নিউজিল্যান্ডের মুঠো থেকে ম্যাচটা বের করে আনেন। শেষ ওভারে ১৪ রান তুলে নিয়ে শেষ পর্যন্ত সুপার ওভারে ম্যাচটাকে টেনে নিয়ে যান বেন স্টোকসই। সুপার ওভারেও স্টোকসের ওপরই ভরসা রাখে ইংল্যান্ড। সুপার ওভারে ৪ বলে ১১ রান নিয়ে অধিনায়কের মান রাখেন স্টোকস। নির্ধারিত সময়ে মানে ৫০ ওভারের ইনিংসে বেন স্টোকসের করা ৯৮ বলে ৮৪ রানের ইনিংসটি নিশ্চয়ই তার ক্যারিয়ারের অন্যতম ঝলমলে। কারণ এই এক ইনিংসইতো দিলো সোনালি রংয়ের ট্রফিটি। বিশ্বকাপে ম্যাচ সেরা, ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। বিশ্বসেরা হতে আর কী লাগে!
ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলসে এবার বসেছিল বিশ্বকাপের দ্বাদশ আসর। আগের আসরগুলো মিলিয়ে সর্বোচ্চ পাঁচবারের শিরোপা জেতা দল অস্ট্রেলিয়া। দুবার করে জিতেছে ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। একবার করে টাইটেল গেছে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায়। নিউজিল্যান্ড বা ইংল্যান্ড আগে কখনোই শিরোপা জিততে পারেনি। সেই খরা কাটাল ইংল্যান্ড। আর ১৯৯৬ সালের পর নতুন কোনো দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ ট্রফিতে চুমু খেল থ্রি-লায়ন্সরা। আগেও একবার শিরোপার মঞ্চে গিয়েছিল চলতি আসর নিয়ে মোট আটবার সেমিফাইনালে খেলা নিউজিল্যান্ড। এবার নিয়ে ফাইনালে আসাটা দুইয়ে দাঁড়ায়। প্রথমবার গত আসরেই, তাসমান সাগরপাড়ের প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যৌথ আয়োজক ছিল তারাও। ফাইনালে অজিদের কাছেই ভেঙে পড়ে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের দল। এবার কাঁদাল ইংল্যান্ড। শেষ ওভারে ১৫ রান আটকাতে পারলেন না ট্রেন্ট বোল্ট, যে কারণে শেষ দিকে প্রায় নিশ্চিত দেখতে পাওয়া ট্রফিটি গতকাল পুরস্কার বিতরনী মঞ্চে তারা দেখলো দূর থেকে। ইংল্যান্ড প্রথমবার ফাইনালে ওঠেছিল সেই ১৯৭৯ সালে, টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় আসরেই, হারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে। পরে ইংলিশরা আরও দুবার ফাইনালে খেলেছে, ১৯৮৭ সালে হারে অস্ট্রেলিয়ার কাছে। পরেরবার ১৯৯২ আসরে হার পাকিস্তানের কাছে। কখনোই শিরোপা জিততে না পারা ইংলিশরা এবার চতুর্থবারের মতো শিরোপার মঞ্চে এসে করল বাজিমাত। ইংল্যান্ড শিরোপার পথে সেমিতে ৮ উইকেটে হারিয়ে আসে অস্ট্রেলিয়াকে। লিগ পর্বে গেছে নানা চড়াই-উতরাই। ৯ ম্যাচে ৬ জয় ও ৩ হারের পথ মাড়িয়ে ১২ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের তিনে থেকে সেরা চারে পা রেখেছিল মরগান-রুটদের দল। নিউজিল্যান্ডও সেখানে গেছে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে। সেরা চারে এসেছে চতুর্থ দল হিসেবে। লিগ পর্বে ৯ ম্যাচে ৫ জয় ও ৩ হারের সঙ্গে একটি বৃষ্টি বিঘিœত ম্যাচে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে সেমিতে আসে উইলিয়ামসন-বোল্টদের দল। তবে চার নম্বর দল হিসেবে সেমিতে এলেও ভারতকে ১৮ রানে হারিয়ে সবার আগে ফাইনালের টিকিট কেটেছিল কিউইরাই। গতকাল দিনশেষে তারা রানার্সআপ। দীর্ঘ ৪৬ দিনের লড়াই শেষে ক্রিকেটবিশ্বের চোখ আটকে ছিল লর্ডসে। মহারণের মঞ্চ প্রস্তুত ছিল, নিজেদের শান দিয়ে রেখেছিল প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। কুশীলব হিসেবে একদিকে স্টোকস-আর্চাররা, অন্যদিকে গাপটিল-টেলররা। ক্রিকেট ভাগ্য হেলে গেল ইংলিশদের দিকেই, রোমাঞ্চের শেষে বিশ্বকাপের নতুন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বেছে নিল ক্রিকেদের জন্মভূমি ইংল্যান্ডকে!

Latest Posts

spot_imgspot_img

Don't Miss