spot_img

২৩শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, শুক্রবার
৮ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সর্বশেষ

জেদে এসপি জাহাঙ্গীর ফাঁসিয়ে গেলেন সাংবাদিকদের!

ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার কারণে প্রত্যাহার হয়েছিলেন জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম সরকার। কিন্তু ফেনী ছেড়ে যাওয়ার সময় তিনি ‘জেদ মিটিয়ে গেছেন’ জেলার সাংবাদিকদের ওপর। তার অধীনস্থ বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) ডেকে কয়েকজন সাংবাদিককে মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছেন জাহাঙ্গীর। এমনকি প্রায় মীমাংসার পথে থাকা মামলার চার্জশিটেও সাংবাদিকদের নাম ঢুকিয়ে দিতে বাধ্য করেছেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, নুসরাত হত্যার রহস্য উদঘাটন ও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা তুলে ধরতে সক্রিয় ভূমিকার কারণেই এসপি জাহাঙ্গীর অনৈতিকভাবে ‘খেদ মিটিয়েছেন’ পেশাদার সাংবাদিকদের ওপর।
বিভিন্ন সূত্র এবং নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ওসির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এজাহারে নাম না থাকা সত্ত্বেও চার্জশিটে সাংবাদিকদের নাম ঢোকাতে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের এসিআর আটকে রাখেন পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর সরকার। এসব মামলার চার্জশিটে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নাম বাদ দিয়ে সুকৌশলে সাংবাদিকদের নাম ঢোকাতে বাধ্য করেন জাহাঙ্গীর।
গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন ওই প্রতিষ্ঠানের আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত। সেদিনই স্থানীয় জনতা অধ্যক্ষকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে। এ ঘটনায় রাফির মা শিরীন আক্তার বাদী হয়ে থানায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। তবে মামলা প্রত্যাহার করতে নুসরাত ও তার পরিবারকে হুমকি-ধমকি দেন অধ্যক্ষের সহযোগীরা। একপর্যায়ে ৬ এপ্রিল পরীক্ষার পূর্ব মুহূর্তে মাদরাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল মৃত্যু হয় নুসরাতের।
প্রথমে ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ বলে প্রচার করেন সোনাগাজী মডেল থানার প্রত্যাহার হওয়া ওসি (বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। তার পক্ষে অবস্থান নেন পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার। ঘটনাটি নিয়ে যখন দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম সরব হয়, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন নুসরাতের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা ও ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারে নির্দেশ দেন, তখনো বিস্ময়কর নির্লিপ্ততা দেখান এসপি জাহাঙ্গীর সরকার। সোনাগাজীতে পর্যন্ত যাননি তিনি।
মামলায় সিরাজ উদ-দৌলাসহ কয়েকজনকে আসামি করতে এসপি-ওসি টালবাহানা করেন বলে নুসরাতের পরিবারের পক্ষ থেকে তখন অভিযোগ ওঠে। শুধু তাই নয়, পুলিশ সদরদপ্তরেও তিনি (এসপি) ওসির পক্ষে সাফাই গেয়ে চিঠি লিখেন। তাদের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা প্রকাশ পেলে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠে।
মামলাটি পিবিআইতে স্থানান্তরের পর ঘটনায় জড়িতরা একে একে গ্রেফতার হতে থাকেন। বেরিয়ে আসে ঘটনার মূল রহস্য। একপর্যায়ে পুলিশ সদরদপ্তরের তদন্তে এসপি-ওসিসহ চার পুলিশ কর্মকর্তা দোষী সাব্যস্ত হন। ওসি মোয়াজ্জেমকে বরখাস্ত করে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। আর এসপি জাহাঙ্গীর সরকারকে প্রত্যাহার করে সংযুক্ত করা হয় পুলিশ সদরদপ্তরে। অপর দুইজনকেও প্রত্যাহার করে পার্বত্য এলাকায় সংযুক্ত করা হয়।
যৌন নিপীড়নের অভিযোগ দিতে গেলে নুসরাতের সঙ্গে অশোভনীয় আচরণ করে তার জবানবন্দি রেকর্ড করায় এবং পরবর্তীতে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ায় বরখাস্ত হওয়া ওসি মোয়াজ্জেমের হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। ওই মামলায় কারাগারে রয়েছেন ওসি মোয়াজ্জেম। জানা যায়, প্রথমে এ জবানবন্দি রেকর্ডের বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরে ওসি মোয়াজ্জেম তার মোবাইল থেকে ফুটেজটি চুরির অভিযোগ এনে সময় টিভির ফেনী ব্যুরোর রিপোর্টার আতিয়ার হাওলাদার সজলের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে সজলও পাল্টা জিডি করেন।
জেলা পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এসপি জাহাঙ্গীর ফেনী ছাড়ার আগেই কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এ সময় তিনি এ ঘটনায় তাকে নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কয়েকজন সাংবাদিককে হেনস্থা করার পরিকল্পনা নেন। তাদের নাম সংবলিত একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের ধরিয়ে দেন। বিভিন্ন তদন্তাধীন মামলায় সেই সাংবাদিকদের নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন। কয়েকজন ওসি কৌশলে এড়িয়ে গেলেও অন্যদের এসিআর আটকে রাখার ভয় দেখিয়ে আদালতে চার্জশিট দাখিলের জন্য চাপ দেন এসপি জাহাঙ্গীর সরকার। ১২ মে সন্ধ্যায় তার বদলি আদেশ আসার পর তিনি রাতে জরুরি ভিত্তিতে ওসিদের ডেকে চাপ প্রয়োগ করে কয়েকটি চার্জশিট তৈরি করান এবং পরদিন তা দাখিলে বাধ্য করেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ওসি জানান। এমনকি বিষয়টি গোপন রাখতেও কোর্ট পরিদর্শকসহ অন্যদের নির্দেশ দেন তিনি।
পরে বিভিন্ন সূত্রে এই ‘কাণ্ড’ জানতে পারেন পেশাগত দায়িত্বে ব্যস্ত সাংবাদিকরা। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় ৩, সোনাগাজী মডেল থানায় ২, দাগনভূঞা থানায় ২ ও ছাগলনাইয়া থানায় ২টি মামলার চার্জশিট আদালতে জমা হয়ে যায়। এসব মামলার অধিকাংশই বাদী পুলিশ।
জমা দেওয়া চার্জশিটে সাংবাদিকদের মধ্যে নাম যোগ করা হয় দৈনিক ফেনীর সময় ও সাপ্তাহিক আলোকিত ফেনীর সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন, দৈনিক অধিকার প্রতিনিধি ও অনলাইন পোর্টাল ফেনী রিপোর্ট’র সম্পাদক এস এম ইউসুফ আলী, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সোলায়মান হাজারী ডালিম এবং দৈনিক সময়ের আলো প্রতিনিধি ও দৈনিক স্টার লাইনের স্টাফ রিপোর্টার মাঈন উদ্দিন পাটোয়ারীর। তদন্ত সূত্র জানায়, মামলার এজাহারে এদের কারও নাম না থাকলেও বিস্ময়করভাবে চার্জশিটে তাদের নাম ঢোকাতে ওসিদের বাধ্য করেন এসপি জাহাঙ্গীর সরকার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উল্লিখিতদের নামে ফেনীর কোনো থানায় ইতিপূর্বে সাধারণ ডায়েরিও ছিল না। বিতর্কিত এসপি জাহাঙ্গীর সরকারের রোষানলে পড়ে এক সপ্তাহের মধ্যে তারা প্রায় ১০টি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়ে যান। বিষয়টি জানাজানি হলে ফেনীতে কর্মরত সাংবাদিক ও সচেতন মহলে ক্ষোভ-অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়াও ছাগলনাইয়া উপজেলায় কর্মরত দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত মামলায় বাদী সমঝোতায় গেলেও ওই দু’জনের বিরুদ্ধেও আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়। এই ‘কাণ্ডে’র শিকার অনলাইন পোর্টাল ছাগলনাইয়াডটকম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির লিটন ও দৈনিক যুগান্তরের ছাগলনাইয়া প্রতিনিধি নুরুজ্জামান সুমন জানান, প্রতিহিংসাবশত এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকারের নির্দেশে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ফেনী প্রেসক্লাবের সভাপতি আসাদুজ্জামান দারা বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক চার্জশিট দাখিল খুবই দুঃখজনক ঘটনা। পুলিশ-সাংবাদিক একে অপরের শত্রু নয়। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা পুলিশ এবং সাংবাদিকদের মধ্যে বৈরিতার সৃষ্টি করবে। পেশাদার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পুলিশের এমন বিরূপ আচরণ কাম্য নয়।
ফেনী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক নুরুল করিম মজুমদার বলেন, এ ধরনের ঘটনা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করে। পেশাদার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক চার্জশিট জমা দেখে আমরা আশ্চর্য হয়েছি, হতভম্ব হয়েছি। আমরা এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি।
ফেনী রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি আরিফুল আমিন রিজভী বলেন, কিছু অতি উৎসাহী পুলিশ হয়রানি করার জন্যে উদীয়মান তরুণ সাংবাদিকদের মামলায় জড়িয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করার চেষ্টা করে করেছে। এ ধরনের ঘটনা খুবই নিন্দনীয়। আমরা এ ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
ফেনীতে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠনের নেতারা ইতোমধ্যে নবাগত পুলিশ সুপার (এসপি) খোন্দকার নুরুন্নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিষয়টি অবহিত করেছেন। এসপি সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন, নতুন করে আর কোনো মামলায় সাংবাদিকদের জড়ানো হবে না।
তবে আগে জমা দেওয়া চার্জশিট নিয়ে তার কিছু করার নেই বলেও জানান এসপি খোন্দকার নুরুন্নবী।

 

চস/আজহার

Latest Posts

spot_imgspot_img

Don't Miss