সেদিন সকাল থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো, টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ যেনো টিনের চালে খেলা করছে। আমি আমার পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বই খোলে কবিতার প্রচ্ছদ দেখছিলাম আর ভাবতেছিলাম আমার তো আর এদেশে থাকা হবে না,প্রিয় মাতৃভুমি ছেড়ে ভারত যেতে হবে,আমি বাবা মা’র একমাত্র সন্তান আর কোনো প্রকারেই মা এই দেশে থাকতে চান না,ভারতে মায়ের এক মামা থেকেন মা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেখানেই চলে যাবেন,দেশে যুদ্ধ লেগেছে,পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের দেশে আক্রমণ করেছে।ভিতুর মতো নিজের ভিটা বাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিজের মাতৃভুমি ত্যাগ করা লাগবে? ভাবতেই খুব খারাপ লাগে কিন্তু কি করার আমার মা বাবা যে আমাকে খুব ভালোবাসেন উনারা বলেন যুদ্ধ শেষ হলেই দেশে ফিরে আসবো।হটাৎ করেই পাশের বাড়ির কাকু ভেজা শরিরে আমাদের বাড়িতে এসে প্রবেশ করলেন,আমি তখন ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম, কাকু আমাকে বললেন তুমার বাবা ঘরে আছেন?আমি বাবাকে ডেকে দিলাম, কাকু আর বাবা ঘরের ভিতর কি যেনো আলাপ করছিলেন,জানার কৌতুহলে আমি একটু এগিয়ে গেলাম বাবা আমাকে দেখে বললেন তুমি বাহিরে গিয়ে খেলা করো, মা পুকুর পাড়ে থালাবাসন মাজছিলেন আর বলতেছিলেন কালই ভারত রওয়ানা দিবো। মা থালাবাসন নিয়ে ঘরে ঢুকার আগেই কাকু ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলেন,দিন গড়িয়ে রাত চলে এলো তখনো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো। মা রাতেই কাপড়চোপড় গয়ানা ঘাটি গুছিয়ে নিচ্ছিলেন ভোরেই আমরা রওয়ানা দেবো,বাবা চুপ করে বসে কি যেন ভাবছিলেন।গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে রাত চলে গেলো।ভোরেই মা আমাকে ডাক দিয়ে বললেন তাড়াতাড়ি উঠে পর, আমিও তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম, তখন বিছানার উপর বাবা নিঃচুপ হয়ে বসে আছেন আর চোখগুলো লাল হয়ে আছে,আমি উপলব্ধি করলাম গতকাল রাত বাবা ঘুমান নি।মা বাবাকে ডেকে বললেন কই তৈরী হয়ে নাও, বাবা চুপ করে রইলেন,কিছুক্ষন পর বাবা বললেন হ্যাঁ যাবো তবে দেশ ছেড়ে নয় দেশের মানুষকে বাঁচাতে যুদ্ধে যাবো,মা বিস্ময়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলেন আর আমি বাবার চোখে ক্রুদ্ধ আভাস দেখতে পেলাম,বাবা বললেন ডাক এসেছে শেখ মুজিবুর রহমানের, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে,শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে,আমাকে যেতে দাও,দেশের লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত মানুষের জন্য যেতে দাও, হাজার মায়ের সন্তানের জন্য যেতে দাও,মা ও মাটির জন্য যেতে দাও,এরমধ্যেই কাকা উনার কয়েকজন বন্ধু নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসলেন, বাবাকে বললেন কি তৈরী হয়েছো?বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আর বললেন হয়তো ফিরে না-ও আসতে পারি,তোর মায়ের দিকে খেয়াল রাখিস,মা’য়ের অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে আমিও অশ্রুসিক্ত হেয়ে গেলাম আর বাবাকে বিদায়বেলা পিছন থেকে তাকিয়ে রইলাম।বাবার সাথে এটাই ছিলো আমার শেষ দেখা,আজও বাবার সেই স্মৃতি আর শেষ কথা গুলো আমাকে গভীর ভাবে সাড়া দেয়।
লেখক : আহমেদ রুমন
সিলেট