কথিত বড় ভাইদের ছত্রচ্ছায়ায় চট্টগ্রাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় ২০টি কিশোর গ্যাং। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই গ্রুপগুলো জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের বিরোধে। চলতি বছরের গত ১০ মাসে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয়েছে ৮ জন। যার সর্বশেষ বলি- মো. নাহিদ (১৯) নামে এক তরুণ। এ ছাড়া কিশোর অপরাধের কারণে নগরের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে অন্তত ১০টি।
রোববার (৩ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে নগরের খুলশী থানার আমবাগান এলাকায় ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসের পাশে ঘটে নাহিদ হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ।
জানা গেছে, নিহত নাহিদসহ কয়েকজন তরুণ-যুবক আগে ঘটে যাওয়া কোনো একটি ঘটনার প্রতিশোধ নিতে তারই বন্ধু সোহেলকে মারতে গিয়েছিল। কিন্তু বন্ধু সোহেলের (২২) স্ক্রু ড্রাইভারের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নাহিদ নিজেই।
নিহত মো. নাহিদ (১৯) স্থানীয় রাজমিস্ত্রি মো. আবদুল্লাহর ছেলে। অভিযুক্ত মো. সোহেলও (২২) একই এলাকার বাসিন্দা ও গ্যারেজ মিস্ত্রি।
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, দুই গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে মারামারি চলছিল। কয়েকজন নারী তাদের ছাড়াতে চেষ্টা করছে। অন্যরা যখন সোহেলকে মারছিল, তখন নাহিদ কিছুটা পিছিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। রাস্তায় পড়ে আবার টলতে টলতে উঠে কয়েক পা এগিয়ে গেট ধরে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে ঢলে পড়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নাহিদ রাস্তায় পড়ে গেলে স্থানীয়রা তাকে ধরাধরি করে মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শনিবার (২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় সোহেলের কথায় তারা সংঘবদ্ধভাবে লাঠিসোঁটা হাতে আমবাগান এলাকায় গিয়ে নাহিদকে হুমকি দেয়। পরে এলাকার কিশোর-তরুণরা সংঘবদ্ধ হয়ে সোহেলদের ধাওয়া দেয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ দুই গ্রুপকে দুই দিকে সরিয়ে দেয়।
সোহেল আমবাগান এলাকায় থাকলেও তার সঙ্গে পিচ্চি হানিফ, পাপ্পু, রায়হানসহ লালখান বাজার এলাকার চিহ্নিত কিছু সন্ত্রাসীর সখ্যতা ছিল।
মূলত, নগরের লালখান বাজারের এক আওয়ামী লীগ নেতার অনুসারী ও কাউন্সিলর হিরণের অনুসারীদের মধ্যে শনিবার সন্ধ্যায় ওই ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও মারামারি হয়েছিল।
এরই জের ধরে রোববার (৩ নভেম্বর) সোহেলকে একা পেয়ে নাহিদসহ কয়েকজন তাকে মারধর করতে থাকে। স্থানীয় নারীরা তাদের ছাড়িয়ে নিতে গেলেও এরই ফাঁকে সোহেলের হাতে থাকা স্ত্রু ড্রাইভারে দিয়ে সে নাহিদের পেট ফুটো করে দেয়।
খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রণব চৌধুরী বলেন, ‘গুরুতর আহত অবস্থায় আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক নাহিদকে মৃত ঘোষণা করেন। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে নাহিদরা কয়েকজন মিলে সোহেলকে মারতে গিয়েছিল। সেখানে সোহেল স্ক্রু ড্রাইভার পেটে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে খুন করেছে। এ সংক্রান্ত সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ আমরা জব্দ করেছি। ঘটনার পর সোহেল পালিয়ে গেছে।’
নগরের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফেসবুক-টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ খুলে নিজেদের সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়াচ্ছে গ্যাং কালচারের কিশোর সদস্যরা। অনেক সময় দেখা যায়, স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে ঝামেলা হলে এরা ওই গ্রুপের মাধ্যমে অন্য সদস্যদের সে ঘটনা জানিয়ে দেয়। এরপর স্কুল ছুটি হলে তারা একত্রিত হয়ে অথবা অন্য সময়ে একজন আরেকজনের ওপর হামলা চালায়। প্রেম থেকে শুরু করে তুচ্ছ যে কোনো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী সংঘাতে।’
নগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র বলছে, ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের জামালখানে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসপারকে প্রকাশ্যে মাথায় গুলি করে হত্যার পরপরই নগর পুলিশ অপরাধচক্রে জড়িত কিশোর এবং অপরাধপ্রবণ এলাকার তালিকা করেছিল। তালিকায় প্রায় ৫৫০ জন কিশোরের নাম এসেছিল। অপরাধপ্রবণ স্পট, যেখানে নিয়মিত আড্ডা বসে, এ ধরনের স্পটের নাম এসেছিল প্রায় ৩০০টি।
কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের জন্য নগরের লালখানবাজার, চকবাজার, নন্দনকানন, সিআরবি, বিশ্বকলোনি, বহদ্দারহাট, পলিটেকনিক এলাকার কয়েকজন আওয়ামী লীগ-যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতার নাম পেয়েছিল পুলিশ। কিশোর-তরুণ অপরাধীদের যারা নিয়ন্ত্রক, তাদের প্রভাব অনেক বেশি। এর ফলে কিশোরদের অপরাধ দমনের বিষয়টি দিন দিন বেড়েই চলছে।
সনাক চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আকতার কবীর চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে কিশোর গ্যাং কালচারের প্রভাব পরিবার থেকে সমাজের সর্বত্র পড়ছে। মূলত, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
চস/আজহার