প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বৈশ্বিক খাদ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পূর্ণ সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গঠনের জন্য ছয় দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ক্ষুধা কোনো অভাবের কারণে নয়, এটি আমাদের তৈরি করা অর্থনৈতিক কাঠামোর ব্যর্থতা। আমাদের এই ব্যবস্থা বদলাতে হবে।’
ইতালির রোমে জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদর দফতরে আয়োজিত বিশ্ব খাদ্য ফোরামের (ডব্লিউএফএফ) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গতকাল স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টায় দেয়া মূল বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
বৈশ্বিক খাদ্য ও অর্থনৈতিক কাঠামো সংস্কারের ছয় দফা প্রস্তাবে অধ্যাপক ইউনূস প্রথমেই বলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধ করুন, সংলাপ শুরু করুন এবং সঙ্ঘাতপূর্ণ অঞ্চলে খাদ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন’-এর মাধ্যমে ক্ষুধা ও সঙ্ঘাতের দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন ল্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে অর্থায়নের অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে, জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলায় কার্যকর পদপে নিতে হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টিকে থাকার সমতা গড়ে তুলতে সহায়তা করতে হবে। তৃতীয় প্রস্তাবে তিনি বলেন, আঞ্চলিক খাদ্য ব্যাংক গঠন করে খাদ্য সরবরাহ চেইন স্থিতিশীল রাখতে হবে। চতুর্থ প্রস্তাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অর্থায়ন, অবকাঠামো ও বৈশ্বিক অংশীদারত্বের মাধ্যমে সহায়তা দিতে হবে। পঞ্চম প্রস্তাবে তিনি রফতানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাণিজ্যনীতিকে খাদ্যনিরাপত্তার সহায়ক হতে হবে, বাধা নয়। ষষ্ঠ প্রস্তাবে তিনি বলেন, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের তরুণ কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘২০২৪ সালে ৬৭৩ মিলিয়ন মানুষ ুধার্ত ছিল অথচ আমরা যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন করেছি। এটি উৎপাদনের ব্যর্থতা নয়- এটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা, নৈতিক ব্যর্থতা।’ তিনি বলেন, ‘ক্ষুধা দূর করতে যেখানে কয়েক বিলিয়ন ডলার জোগাড় করা যায়নি, সেখানে অস্ত্র কিনতে বিশ্ব ব্যয় করেছে ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। একে কি আমরা অগ্রগতি বলব?’
অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। পুরনো মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা পদ্ধতি কোটি কোটি মানুষকে পেছনে ফেলে দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন এক নতুন ব্যবসা পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে- সামাজিক ব্যবসা, যা ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য নয়, বরং সমাজের সমস্যা সমাধানের জন্য।’
অধ্যাপক ইউনূস তার স্বপ্নের ‘তিন-শূন্য বিশ্ব’ (শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নিঃসরণ) ধারণা ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এটি কোনো কল্পনা নয়, এটি অপরিহার্য- বিশ্ব বাঁচানোর একমাত্র পথ।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবসার সাফল্য আমরা দেখেছি। গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়েছে, দরিদ্র নারীরাও উদ্যোক্তা হতে পারেন। গ্রামীণ দানোন শিশু অপুষ্টির বিরুদ্ধে কাজ করছে। বিশ্বজুড়ে এমন বহু সামাজিক ব্যবসা মানুষের জীবন বদলে দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘তরুণ, নারী, কৃষক, কৃষি উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবকদের সহায়তায় সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠন করতে হবে। এই ধরনের উদ্যোগের জন্য আইনগত ও আর্থিক কাঠামো তৈরি করতে হবে, বাধা নয়।’
বক্তৃতার শুরুতে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এফএও’র ৮০ বছর পূর্তি শুধু উদযাপন নয়, এটি ভবিষ্যতের প্রস্তুতির আহ্বান।’ তিনি বলেন, ‘এ বছরের প্রতিপাদ্য- ‘হাত ধরে হাতে, উন্নত খাদ্য ও উন্নত ভবিষ্যতের পথে’- আমাদের মনে করিয়ে দেয়: খাদ্য শুধু ক্যালরির ব্যাপার নয়, এটি মর্যাদার, ন্যায়ের এবং আমরা কেমন পৃথিবীতে বাস করতে চাই তার প্রতিচ্ছবি।’
প্রধান উপদেষ্টা ২০২৪ সালের বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ তরুণ নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘তরুণরা সাহস ও আশায় ভরপুর হয়ে গণতন্ত্র, শান্তি ও মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছে। তাদের দাবি ছিল মতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়া, ন্যায়, অন্তর্ভুক্তি ও আস্থার ভিত্তিতে সমাজ গঠন।’ তিনি যোগ করেন, ‘এ তরুণরাই এখন নতুন বাংলাদেশ গঠনে কাজ করছে- যেখানে জনগণ শাসনের কেন্দ্রে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে, যার মাধ্যমে আমরা ন্যায় ও জনগণের মতায়নের প্রতিশ্রুতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবো।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করছে এবং মিয়ানমারের সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় ও খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে আছি ধান, সবজি ও স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে। কৃষকরা ফসলের নিবিড়তা ২১৪ শতাংশে উন্নীত করেছেন এবং আমরা জলবায়ু সহনশীল ১৩৩ প্রজাতির ধান উদ্ভাবন করেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ করেছি, ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দিচ্ছি, শক্তিশালী খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি, অপুষ্টি কমিয়েছি, খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য এনেছি এবং কৃষিকে সবুজ করেছি- মাটি, পানি ও জীববৈচিত্র্য সংরণে কাজ করছি।’
আইএফএডিকে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠনের প্রস্তাব : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলকে (আইএফএডি) বাংলাদেশের তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা, নারী, কৃষক ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারীদের সহায়তার জন্য একটি সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। রোববার ইতালির রোমে ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামের ইভেন্টের ফাঁকে আইএফএডির প্রেসিডেন্ট আলভারো লারিওর সাথে বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান।
বৈঠকে দুই নেতা বিভিন্ন কৌশলগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এর মধ্যে ছিল বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিল্প গড়ে তোলা, আম ও কাঁঠালের রফতানি সম্প্রসারণ, জলবায়ু সহনশীল কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি এবং মহিষের দুধ দিয়ে মোজারেলা চিজসহ দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনে সহায়তা।
অধ্যাপক ইউনূস আইএফএডি প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং কৃষি, সামাজিক ব্যবসা ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতার সম্ভাবনা যাচাইয়ে একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠানোর অনুরোধ করেন।
প্রত্যুত্তরে আইএফএডি প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের সাথে যৌথভাবে সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগে কাজ করার ব্যাপারে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা ফল প্রক্রিয়াকরণ, কোল্ড স্টোরেজ, গুদাম সুবিধা ও আম-কাঁঠালের বৃহৎ পরিসরে রফতানিতে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি জানান, বাংলাদেশের নারী দুগ্ধ খামারিরা মহিষের দুধ দিয়ে মোজারেলা চিজ তৈরি করছেন। তিনি এ খাত সম্প্রসারণে আইএফএডির সহায়তা চান।
বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে আইএফএডি ৩৭টি প্রকল্পে অংশীদার হয়েছে, যার মোট প্রকল্প ব্যয় ৪ দশমিক ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার সরাসরি আইএফএডি অর্থায়ন করেছে। বর্তমানে ৪১২ মিলিয়ন ডলারের ছয়টি প্রকল্প চলমান এবং আরো একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন।
চস/স