spot_img

৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, সোমবার
২৪শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সর্বশেষ

চট্টগ্রামে ৪০ বছরে ১২০ পাহাড় সাবাড়

গত ৪০ বছরে ১২০টি পাহাড় হারিয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরী। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বর্তমানে যে পাহাড় আছে, তা অর্ধেকে নেমে আসতে পারে।

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নেই সাবাড় হচ্ছে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র, কমিশনারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা নেতৃত্ব দিয়েছেন পাহাড় কাটায়। তাদের কারণেই চট্টগ্রাম নগরের নর্দান হিল বলে পরিচিত পাহাড়গুলোর প্রায় সবই সাবাড় হয়েছে।

মহানগরীর আকবর শাহ থানার উত্তরের এলাকাটি একসময় সুউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা ছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ২০০৬ সালে এসব পাহাড় কেটে ৫৪৮ প্লট তৈরি করে লেক সিটি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলে। পরবর্তীকালে ২০০৭ সালে দক্ষিণ খুলশীতে পাহাড় কেটে সিটি করপোরেশন ভিআইপি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলে। ২০০৮ সালের দিকে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের পশ্চিমে কোবে হাউজিং এলাকায় পাহাড় কেটে সমতল করা হয়। অন্যদিকে চন্দ্রনগর এলাকায় পাহাড় কেটে সমতল করা হয়েছে।

সিটি করপোরেশনের কয়েকটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধেও পাহাড় কাটার অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান (তৎকালীন প্রধান নির্বাহী বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলা) গত বছর জানুয়ারিতে আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কাটা পরিদর্শনে এলে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জহুরুল আলমের অনুসারীরা তাকে ধাওয়া করেছিল। এ ঘটনায় বেলার পক্ষ থেকে মামলাও হয়েছে।

এ ছাড়া একই এলাকার উত্তরে জঙ্গল ছলিমপুরেও ছিন্নমূলের নেতৃত্বে ব্যাপক হারে পাহাড় কাটা হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর গত ৩০ বছরের ভূমির বৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে পাহাড় কাটায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। আর তাদের নেতৃত্বে পাহাড়গুলো সাবাড় হয়েছে। বর্তমানে যে ৭-৮ শতাংশ পাহাড় রয়েছে সেগুলোও আগামী ১০ বছরের মধ্যে অর্ধেকে নেমে আসবে।’ তিনি বলেন, আবাসনের চাহিদা মেটাতে নগরীর পাহাড়গুলো সাবাড় করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বালুর আধিক্য বেশি থাকায় তা অতিবৃষ্টিতে ক্ষয় হয়ে যায়।

জানা গেছে, অভিজাত খুলশী আবাসিক এলাকা পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে। শহরের ভেতরের সার্সন রোডে বিভারলি হিলস আবাসিক এলাকা, চশমা পাহাড় আবাসিক এলাকা, রহমান নগর আবাসিক এলাকা, বায়েজীদের হিলভিউ আবাসিক এলাকা, দক্ষিণ খুলশী আবাসিক এলাকা, দক্ষিণ খুলশীতে সিটি করপোরেশনের ভিআইপি আবাসিক এলাকা, জালালাবাদ আবাসিক এলাকা, পশ্চিম খুলশী আবাসিক এলাকা, ফয়’স লেকের লেকভ্যালি আবাসিক এলাকা ও লেকভিউ আবাসিক এলাকা, কৈবল্যধাম বিশ্বব্যাংক কলোনি, একই এলাকায় সিটি করপোরেশনের লেকসিটি আবাসিক এলাকা, জঙ্গল লতিফপুরের শাপলা হাউজিং সোসাইটিসহ অনেক বসতি পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে সাবাড় হচ্ছে নগরীর পাহাড়।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বোর্ড সদস্য স্থপতি জেরিনা হোসেন বলেন, ‘যেহেতু চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো বালু মাটির পাহাড়, তাই কোনো পাহাড়ে কীভাবে ভবন নির্মাণ করা যাবে; তা নিয়ে দিকনির্দেশনা নিতে হবে। কিন্তু আমরা পাহাড়গুলো কেটে সমান করে কিংবা নিজেদের ইচ্ছেমতো কেটে ভবন নির্মাণ করছি। আর এতেই বিপত্তি ঘটছে।’

এদিকে পাহাড়ে ভবন নির্মাণে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই জানিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী বলেন, ‘চট্টগ্রাম যেহেতু পাহাড়ি এলাকা তাই অবশ্যই ভবন নির্মাণে সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা পাহাড়ি এলাকাগুলোতে নিয়ন্ত্রিতভাবে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়ে থাকি। চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রায় ১২টি আবাসিক এলাকা পাহাড়ি এলাকায় গড়ে উঠেছে। তাই পাহাড়কে অস্বীকার করে চট্টগ্রামের আবাসন চিন্তা করা যাবে না।’

পাহাড় কমে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক জিএন তানজিনা হাসনাত ও একই বিভাগের মোহাম্মদ আলী বাবু ‘আরবান ল্যান্ডস্কেপ চেঞ্জ ডিটেকশন ইউজিং জিআইএস অ্যান্ড আর এস’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে। ২০২২ সালে প্রকাশিত সেই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গত ৩০ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড়-জঙ্গলের সবুজ কমেছে ২১ দশমিক ৮২ শতাংশ আর পুকুর-জলাশয় কমেছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ১৯৯০ সালে নগরীর মাত্র ১৯ শতাংশ এলাকায় বসতি থাকলেও এখন ৪৫ শতাংশ এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক খালেদ মিসবাহ উজ্জামান বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার এক সেমিনারে ‘হিল কাটিং ইন চিটাগাং সিটি’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে গত ৪০ বছরে হারিয়ে গেছে ১২০টি পাহাড়। একটি মাত্র সড়ক নির্মাণেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কেটে ফেলেছে ১৬টি পাহাড়। সবচেয়ে বেশি পাহাড় বিনষ্ট হয়েছে আবাসিক এলাকা নির্মাণে। এক-দুই বছরে নয়, অনেক বছরে পর্যায়ক্রমে। অবশিষ্টগুলোও সাবাড় হওয়ার পথে।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক হাসান হাসিবুর রহমান বলেন, আমরা পাহাড় কাটা বন্ধ করতে এখন সপ্তাহের ছুটির দিনেও ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে গণমানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন। সামাজিকভাবে এগিয়ে আসা গেলে পাহাড় কাটা বন্ধ করা যাবে।

সূত্র: দৈনিক দেশ রূপান্তর

চস/স

Latest Posts

spot_imgspot_img

Don't Miss