প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ১০ দফা দাবি জানিয়ে খোলা চিঠি লিখেছেন ৬৩ সচেতন নাগরিক। রোববার (২২ মার্চ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা গণমাধ্যমে এই চিঠি পাঠিয়েছেন।
চিঠিতে বলা হয়, কোভিড-১৯ ভাইরাস দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাপকাঠিতে করোনা সংক্রমণের যে চারটি স্তরের কথা বলা হয়েছে বাংলাদেশ এর তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করেছে, অর্থাৎ দেশের ভেতরেই এই রোগ কমিউনিটি সংক্রমণের পর্যায়ে ঢুকে পড়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চতুর্থ স্তরটি হলো, ব্যাপক সংক্রমণ ও ব্যাপক মৃত্যু। চীন, ইরান, ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি থেকে আমরা পরিষ্কার ধারণা করতে পারি যে, কীভাবে অতি দ্রুত জ্যামিতিক গতিতে এই মহামারি দাবানলের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, দুই মাস সময় পেলেও সরকার সমস্যার দিকে কোনো মনোযোগই দেয়নি। উপদ্রুত দেশগুলো থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনকারী প্রবাসী ভাই-বোনদের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণে কোয়ারেন্টিন করার সরকারি ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে সমন্বয়হীনতা ও প্রস্তুতির অভাব দেশকে কতবড় বিপদে ফেলতে পারে।
মহাবিপদ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেই, সমন্বয় নেই, আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণের পর্যাপ্ত উপকরণ ও ব্যবস্থাপনা দেশে নেই; নেই চিকিৎসকদের রক্ষার ব্যবস্থা, নেই যথেষ্ট মাস্ক, স্যানিটাইজার ও ভেন্টিলেটার! পরীক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া সরকার আক্রান্ত সংখ্যার যে তথ্য দিচ্ছে তা তাই বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে না। দেশের হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিরাজমান দুর্বলতা ও প্রস্তুতিহীনতা অনুধাবন করে দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
উদ্বেগের আরও কারণ হচ্ছে জাতির মহাবিপদের মুহূর্তে দুর্যোগ মোকাবিলার কোনো সমন্বিত উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো বাস্তবতা অস্বীকার করে ‘সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন’ বলে সরকারের মিথ্যা সাফল্যের বন্দনায় মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের ব্যস্ততা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য আমাদের গভীরভাবে চিন্তিত, ক্ষুব্ধ ও হতাশ করে। বিভিন্ন ছাত্র যুব সংগঠনসহ স্বেচ্ছাসেবী ব্যক্তি ও সংগঠনের দায়িত্বশীল কাজই এখন পর্যন্ত আমাদের ভরসা। কিন্তু এসব উদ্যোগ সমন্বয়েরও কোনো আগ্রহ সরকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।
১. আমরা চাই, সরকার আর কালক্ষেপণ না করে শ্বেতপত্রের মাধ্যমে করোনা মহামারি রোধের পরিকল্পনা ও কার্যকর প্রণালী জনসমক্ষে প্রকাশ করবে। শ্বেতপত্রে থাকবে ঢাকাসহ প্রতিটি জেলা-উপজেলায় কতজন স্বাস্থ্যকর্মী আছেন এবং তাদের সুরক্ষার পর্যাপ্ত সরঞ্জাম কবে পর্যন্ত নিশ্চিত করা যাবে, প্রতিটি হাসপাতালে সর্বোচ্চ কতটি বেড প্রস্তুত করা যাবে, প্রতিটি হাসপাতালে কতটি ভেন্টিলেটর প্রস্তুত আছে, করোনা পরীক্ষার কতগুলো কিট আছে, প্রতিদিনের ব্যবহারের মানসম্মত গ্লাভস, মাস্ক ইত্যাদির মজুত কতদিনের মধ্যে নিশ্চিত করা যাবে, এসব তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
২. অবিলম্বে দেশের সব জায়গায় বিনামূল্যে টেস্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় কিটসহ বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহ ও তার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। মাস্ক, সাবান, স্যানিটাইজার জোগান নিশ্চিত করতে হবে। কিট তৈরির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে দ্রুত খালাস ও কর মওকুফের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. দেশের সব প্রবেশপথ সতর্ক নজরদারির আওতায় নিতে হবে। অবিলম্বে করোনা সংক্রমণের সময় আক্রান্ত দেশগুলো থেকে ফিরে আসা প্রবাসীদের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য বা ইতোমধ্যে আক্রান্ত অঞ্চলের মানচিত্র তৈরি করতে হবে। গুরুত্ব অনুযায়ী অঞ্চলভিত্তিক জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের ভেতর কক্সবাজার পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পর্যটন গন্তব্যগুলো বন্ধ করে দিতে হবে।
৪. কোয়ারেন্টিনের জন্যে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে দূরে বড় হোটেল-মোটেল-রিসোর্টসহ উপযোগী ভবনগুলো অস্থায়ীভাবে ব্যবহারের জন্যে নির্দিষ্ট করতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্টেডিয়াম, জিমনেশিয়াম, খালি ভবনে অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা সম্ভব। সিএমএইচ ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সমন্বিত পরিকল্পনায় যুক্ত করতে হবে।
৫. ডাক্তার-নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর নিরাপদ পোশাক ও প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের দীর্ঘ মেয়াদি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্যে দ্রুত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। দেশের পোশাক কারখানা ব্যবহার করে স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে পিপিই (পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট) সরবরাহ করতে হবে।
আরো পড়ুন: করোনা: ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ১৬৩৪, আক্রান্ত ৩২৪০৬