জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত, সৌন্দর্যময়, অর্থপূর্ণ ও কার্যকরী করার জন্য শিক্ষা অত্যন্ত মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা ব্যতীত অগ্রগতি কোনভাবেই সম্ভব নয়। বলা হয়ে থাকে, শিক্ষার মাধ্যমেই প্রতিটি ব্যক্তি সত্যিকারের মানুষ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তাই শিক্ষায় গলদ থাকলে ব্যক্তির কেবল বয়সই বাড়ে, মনুষত্বের জাগরণ ঘটে না।
পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বলা চলে শিক্ষাব্যবস্থার প্রভু হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যুগোপযোগী, বিজ্ঞানসম্মত, কর্মমুখী, প্রযুক্তিনির্ভর ও বাস্তবসম্মত করতে দরকার কল্যাণমুখী, শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবায়ন।
আমাদের দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষার্থী শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম মূল উপাদান। সাধারণত শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের নীতিমালা পরিচালনা, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে থাকে। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই শিক্ষার্থীবান্ধব এবং কল্যাণমুখী হওয়া অতি বাঞ্ছনীয়। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় কোন নীতি নির্ধারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা যদি শিক্ষার্থীদের জন্য সার্বজনীন সুফলপ্রদ না হয় এবং শিক্ষাব্যবস্থার নীতিনির্ধারণগুলো শিক্ষার্থীদের স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, কেবল তখনই শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের পথকে বেছে নেয়। আন্দোলন হলে শুধু শিক্ষাঙ্গনগুলো নয় বরং আশেপাশের স্বাভাবিক পরিবেশও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, যা আমাদের দেশের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
করোনা মহামারির কারণে পুরো পৃথিবীই আজ স্থবির হয়ে পড়েছে। করোনার প্রভাব যেমন দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও জন-জীবনের উপর প্রভাব ফেলেছে তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রেও বড় প্রভাব ফেলেছে। মহামারি করোনার কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
এক গবেষণায় দেখা যায়, দীর্ঘদিন শিক্ষা কার্যক্রম থেকে দূরে থাকার কারণে এখন ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং ৭৬% শতাংশ অভিভাবক চায় স্কুলগুলো খুলে দেয়া হোক। আবার কোভিড-১৯ এর প্রকোপ পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে তুলনামূলক কম হওয়ার সব তথ্যই নিয়মিত উঠে আসছে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে। শীত মৌসুমে মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানতে পারে বলে যে আশঙ্কা এবং উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল, সেটাও অনেকটা কেটে গেছে। এছাড়া করোনা ভাইরাসের টিকা চলে আসায় পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি গণসাক্ষরতা অভিযানে সারাদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ৩০০০ জনের উপর জরিপ পরিচালনা করে দেখা যায়, প্রায় ৬৯ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনাকালে দূর-শিক্ষণে অংশ নিতে পারেনি।
এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, সৌদি ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হল খুলে দেওয়ায় আমাদের দেশেও শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবি করছে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের মতে, দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মেই চালু রেখেছে সরকার, একইভাবে কোভিড সুরক্ষা নীতি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া দরকার। কেননা শিক্ষার্থীরা সাধারণ মানুষের চেয়ে স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। প্রতিটি শিক্ষার্থী স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে যতটুকু অবগত থাকে তা সাধারণ মানুষের মাঝে খুব একটা দেখা যায় না। সেদিক দিয়ে করোনা প্রকোপ শিক্ষার্থীর চেয়ে সাধারণ মানুষের জন্য বেশি ভয়ংকর।
দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীরা বাড়িতে অবস্থান করার কারণে তাদের মাঝে হতাশা ও পারিবারকেন্দ্রিক মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে আত্মহত্যার প্রবণতাও। আবার অনেক শিক্ষার্থী ক্যারিয়ার ও সেশনজটে আটকে থাকায় তাদের মাঝে দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে, মানসিকভাবেও ভেঙে পড়ছে অনেক শিক্ষার্থী। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিবাহ প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালগুলোতে চলমান পরীক্ষা স্থগিত রাখায় কারণে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, প্রতিবাদের প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যে বিপর্যয়ের মুখে পতিত, সে চিত্রই ভেসে উঠে। দেখা যায় শিক্ষাব্যবস্থার সংকট কিংবা বিপর্যয়ের মাধ্যমে যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের মূল চালিকাশক্তির ভীত পর্যন্ত নড়ে যায়।
একজন শিক্ষার্থীর পেছনে তার স্বপ্ন, তার পরিবারের স্বপ্ন এবং একটি দেশ ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা জড়িত থাকে। শিক্ষার্থীর প্রতি সবসময়ই ইতিবাচক আশা থাকে দেশবাসীর। কেননা আজকে শিক্ষার্থীরাই আগামী সোনার বাংলা গড়ার কারিগর। অথচ শিক্ষাবিষয়ক প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নীতিমালা পরীক্ষাসহ শিক্ষার বিভিন্ন নির্দেশনা প্রণয়ন এবং বিধিবিধান জারি করা, সঠিক ধারণা, তথ্য, সমতা ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত ও দূরদর্শী ভাবনার পূর্ণকার্যকরী না হলে শিক্ষার্থীর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতি কতটুকু প্রসিদ্ধ তা প্রশ্নযোগ্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনা, পরিবর্তনশীলতা ও হটকারী সিদ্ধান্তের জন্য বারবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যার ফলে দিন দিন শিক্ষার্থীদের মাঝে মানসিক অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি অনেকে পড়াশোনা থেকে বিদায় নিতেও আগ্রহী হয়ে উঠছে। অনেক শিক্ষার্থীর মাঝে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার গ্র্যাজুয়েশন শেষ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা চাকরির পরীক্ষা ও বয়সসীমা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।
চলমান পরিস্থিতি যদি সামনেও অব্যাহত থাকে তাহলে শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা করা যায় বৈকি। যার মধ্য দিয়ে একটি জাতির অবনতি ও অবলুপ্তির জোরালো সম্ভাবনা থেকে যায়।
শিক্ষার্থীদের আলোকিত ভবিষ্যতের জন্য সময়োপযোগী, বাস্তবমুখী ও কার্যকরী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। শিক্ষার মাধ্যমে জাতি এগিয়ে যায়, উন্নতির শীর্ষে আরোহন করে। তাই শিক্ষাব্যবস্থার সন্তোষজনক চিত্র সবারই কাম্য।
জ্ঞান অর্জনের সর্বোত্তম নিয়ম-কানুন ও পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যকে সামনে রেখে শিক্ষা বিভিন্ন পদ্ধতি ও নীতি দ্বারা প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের জীবনকে উৎকর্ষমণ্ডিত করাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্প্রসারণশীল হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও শিক্ষার নীতিনির্ধারণ ও পরীক্ষা সংক্রান্ত কার্যাবলীর ক্ষেত্রে ক্রমাগত অবনতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে গতিশীল রাখার নিমিত্তে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দাবির সমাধান ও বাস্তবমুখী শিক্ষানীতির মাধ্যমে করোনা-পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থার সংকট দূরীকরণ যেন এখন সময়ের দাবি। কল্যাণমুখী ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামীর বাংলাদেশ সোনালি ও শক্তিমান রাষ্ট্ররূপে গড়ে উঠবে- এই প্রত্যাশা থাকবে।
রাশেদা আক্তার : অর্থনীতি বিভাগ, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ
চস/আজহার