ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফসলের মাঠ ডুবে গিয়ে কৃষকের মাথায় হাত। বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়াতে মানবেতর জীবনযাপন করছে নিম্নাঞ্চলের মানুষ। অনেকেই নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। বিভিন্ন উপজেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সার্বক্ষণিক খবর নেয়া হচ্ছে। তাদের দুর্ভোগ লাঘবে প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সাথে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
নাজিরহাট: নিজস্ব সংবাদদাতা জানিয়েছেন, গত ৫ দিন যাবৎ অব্যাহত ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ফটিকছড়ি উপজেলার ২০টি গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গ্রামীণ সড়ক চলাচল বন্ধ রয়েছে। উপজেলার সমিতিরহাট ইউনিয়নের আরবানীয় গ্রামে ৮টি বসতঘর হালদা নদীতে তলিয়ে গেছে। আরো ৭ পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। এসব গ্রামে কৃষকের প্রায় ৯০ হেক্টর আউশ ধান ও বীজ তলা ডুবে গেছে। ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে হালদা ও ধুরং নদীর ভাঙ্গা বেড়ি বাঁধ তলিয়ে যাবার কারণে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হবার আশংকা দেখা দিয়েছে। ফলে নদী ও খালের ২ দিকের হাজারো মানুষ আতংকের মধ্যে রয়েছে। ইতোমধ্যে দাঁতমারা ইউনিয়নের হেঁয়াকো-দাঁতমারা সড়ক ও লেলাং ইউনিয়ন অংশে গহিরা-ফটিকছড়ি সড়ক দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। নাজিরহাট বাজারে দু দিকের সর্বস্তরের মানুষের যাতায়াতের পুরাতন হালদা ব্রিজ যেকোন সময় বিধ্বস্ত হয়ে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে পারে।
জানা যায়, গত ২ দিনে উপজেলার সমিতিরহাট ইউনিয়নের আরবানীয় হালদার কুল গ্রামের আবদুর রহিম, মফজল আহম্মদ, মো: বাদশা, মো. ইউনুস, আবু তাহের, মিনু আকতার ও জেবল হোসেনের (৮টি) বসতঘর বিলীন হয়ে গেছে। সংবাদ পেয়ে গতকাল বুধবার দুপুরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সায়েদুল আরেফিন সেখানে ছুটে যান। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার গুলোকে সাহায্যের আশ্বাস দেন।
অন্যদিকে, উপজেলার নাজিরহাট বাজারের ভিতরে বৃটিশ আমলে নির্মিত বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ হালদা সেতু ২ প্রান্তের পিলার ব্যতীত অন্য পিলার গুলোর মাটি সরে গেছে অনেক আগে। ফলে সেতু মধ্যবর্তী স্থানে দেবে গেছে। ভারী বর্ষণের কারণে পানি বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে সেতুটি দোলনার মতো দুলছে। তবুও বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় উক্ত সেতুর উপর দিয়ে প্রতিনিয়ত স্কুল, কলেজ,
মাদ্রাসাগামী শত শত শিক্ষার্থীসহ হাজারো মানুষ যাতায়াত করছে। যেকোন সময় সেতুটি বিধ্বস্ত হয়ে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে পারে।
অপরদিকে, উপজেলার খিরাম ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকা হতে ২০ পরিবারকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে বলে জানান ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন।
উপজেলা কৃষি অফিসার লিটন দেব নাথ বলেন, অব্যাহত বর্ষণে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে শতাধিক হেক্টর বীজতলা ও আমন ধান পানিতে ডুবে রয়েছে। উপজেলার হালদা ও ধুরং নদী, লেলাং খাল, সর্তাখাল, গজারিয়া খাল, মন্দাকিনী খাল ও বার মাসিয়া খালের পানি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নদী ও খালগুলোর বিভিন্ন স্থানের বেড়ি বাঁধ সংস্কার না করায় নদী ও খালের পানি প্রবেশ করে আবারো বন্যা হতে পারে। এসব ভাঙ্গা বেড়ি বাঁধগুলো স্থানীয় জনগণ স্বেচ্ছায় কিছুটা সংস্কার করলে ও তা বর্তমানে তলিয়ে যাচ্ছে। তলিয়ে যাওয়া স্থানের পরিবারগুলো চরম আতংকে আছে।
এদিকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সায়েদুল আরেফিন গতকাল উপজেলার নদী ও খালের কিছু ভাঙ্গন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তাছাড়া তিনি উপজেলার সকল জনপ্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
বান্দরবান: টানা প্রবল বর্ষণে বান্দরবানের সাঙ্গু মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে সহস্রাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এদিকে সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় বান্দরবানের সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বান্দরবান কেরানীহাট সড়কের বাজালিয়া অংশে সড়কের উপর দিয়ে কয়েক ফুট পানি প্রবাহিত হচ্ছে। সোমবার থেকে এ সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সাঙ্গু নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজালিয়া এলাকায় দুশোরও বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বান্দরবানের থানছি সড়কের বলি পাড়া এলাকায় পাহাড় ধস ও সড়কের উপর পানি উঠায় সকাল থেকে এ সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। বান্দরবান রাঙ্গামাটি সড়কে যান চলাচল শুরু হলেও বেশ কয়েকটি স্থানে পাহাড় ধসে পড়ায় ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। বান্দরবান সদরের আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫০টিরও বেশি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সেনাবাহিনী ও পৌরসভার পক্ষ থেকে খিচুড়ি ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
পটিয়া: নিজস্ব সংবাদদাতা জানিয়েছেন, তৃতীয় দিনের অতি বর্ষণে ও শ্রীমাই খালে পাহাড়ি ঢলে পটিয়া উপজেলার কচুয়াই ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের পারিগ্রাম সূত্রধর পাড়ায় ৮টি ঘর বিলীন হয়ে গেছে। বুধবার সন্ধ্যায় উপজেলার কচুয়াই ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের পারিগ্রাম এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে নেপাল সূত্রধর, অমূল্য সূত্রধর, মিলন সূত্রধর, সুমন সূত্রধর, ভুলু সূত্রধর, দীপক সূত্রধর, সিপক সূত্রধর ও দুলাল সূত্রধরের ঘর কম বেশি বিলীন হয়েছে। মাটির এসব বসত ঘর ভেঙে অনন্ত ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। জানা গেছে, টানা তিন দিনের প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানি শ্রীমাই খাল হয়ে নামতে থাকে। পাহাড়ি ঢলের পানিতে উপজেলার কচুয়াই, ছনহরা ও ভাটিখাইন এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পটিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাবিবুল হাসান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন এবং ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন। কচুয়াই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস,এম, ইনজামুল হক জসিম জানিয়েছেন, টানা বৃষ্টির পানি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে ৭নং ওয়ার্ডের পারিগ্রাম এলাকার সূত্রধরপাড়ার ৮টি বসতঘর কম বেশি খালে বিলীন হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান।
রাঙ্গুনিয়া: নিজস্ব সংবাদদাতা জানিয়েছেন, কয়েকদিনের টানা বর্ষণে রাঙ্গুনিয়ার বগাবিলী সড়কে ধস দেখা দিয়েছে। সড়কটি পাশ্ববর্তী ইছামতি নদীতে তলিয়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ঝুঁকি নিয়ে এই সড়ক দিয়ে চলাচল করছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরাও। জনদুর্ভোগ লাঘবে সড়কটি দ্রুত সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৩ জুন ভয়াবহ বন্যায় সড়কটি ধসে গিয়ে বেহাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর থেকে বিধ্বস্ত সড়ক দিয়েই মানুষ এতদিন যাতায়াত করে আসছিল। চলতি বছরের মার্চ মাসে স্থানীয়রা লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে সড়কটি সংস্কার করে। বালুভর্তি বস্তাসহ বেড়িবাঁধ দিয়ে সড়কটি চলাচলের উপযোগী করে তোলা হয়। সম্প্রতি আবারও টানা বৃষ্টিতে এটি পুনরায় ধসে গিয়ে আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে।
বগাবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এস.এম ইকবাল রশীদ বলেন, ‘বিদ্যালয়ে আসা যাওয়ার একমাত্র সড়ক এটি। এটি দিয়ে প্রতিদিন বিদ্যালয়ের ৮ শতাধিক শিক্ষার্থী চলাচল করে। তাই জনস্বার্থে সড়কটি দ্রুত সংস্কার করা সময়ের দাবি।’
স্থানীয় মো. রফিক বলেন, সড়কটি প্রতিবছর বর্ষা এলেই ইছামতি নদীতে তলিয়ে যায়। এরপর এলাকার মানুষ টাকা উঠিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে এটি পুনরায় সংস্কার করেন। এবছরও সংস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু আবারও ধসে গিয়ে চরম বিপাকে পড়েছি আমরা।’
রহিম উদ্দিন নামে অপর এক ব্যক্তি বলেন, বগাবিলী সড়কটি এই এলাকার মানুষের যাতায়াতের অন্যতম প্রধান সড়ক। এটি বিধ্বস্ত হওয়ায় এলাকাবাসীর যোগাযোগ অনেকটা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। তাই এটি দ্রুত সংস্কার করা জরুরি। এক্ষেত্রে তিনি রাঙ্গুনিয়ার সাংসদ তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
গত সোমবার সকালে সড়কের এই বেহাল দশা পরিদর্শনে আসেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান। এসময় সহকারী কমিশনার (ভূমি) পূর্বিতা চাকমা সহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। পরিদর্শনকালে ইউএনও মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর দুর্ভোগ লাঘবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
***পূর্বকোণের সৌজন্যে***
চস/ সোহাগ