ভয়াবহ বন্যায় ফেনী জেলাজুড়ে প্রায় ৬৭ হাজার ২৮৭ হাজার কাঁচাপাকা ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে বন্যার্তদের আনুমানিক ৬৯২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। -খবর বার্তা২৪ এর
বসতবাড়িতে ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণে ঘর মেরামতে ব্যয়, আসবাবপত্রের ক্ষতি এবং নিত্য ব্যবহার্য বৈদ্যুতিকসামগ্রী মেরামতে ব্যয় হিসাবকে ভুক্তভোগী প্রতি ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে, চলমান বন্যা নিয়ে গবেষণা সংস্থা অক্সফামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যাকবলিত এলাকায় ধ্বংস হয়েছে ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে- ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক সামগ্রীর সর্বোচ্চ ক্ষয়ক্ষতি দেখা গেছে ফুলগাজীতে। সবচেয়ে কম ক্ষয়ক্ষতি লক্ষ্য করা গেছে দাগনভূঞা এবং সোনাগাজীতে। এই দুই উপজেলায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার।
এছাড়া ফেনী সদরের কালীদহ ইউনিয়ন, মোটবী ইউনিয়ন এবং ধর্মপুরে সর্বাধিক ক্ষতি হয়েছে। এই তিন ইউনিয়নে প্রায় ১ হাজার ৬০০ পরিবারের ঘরবাড়ি পনিতে তলিয়ে গেছে। ক্ষয়ক্ষতি প্রায় ২০ কোটি টাকা। পৌর এলাকার মাস্টারপাড়া, মৌলভীবাজার, একাডেমি, রামপুরসহ একাধিক আবাসিক এলাকায় এক হাজারের বেশি পানির মোটর বন্যার পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে বলে মেরামতকারীদের সূত্রে জানা গেছে। শহরে বাড়িঘরে ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৪০ কোটি টাকা হতে পারে বলে ভুক্তভোগীদের তথ্যে উঠে এসেছে। সদর উপজেলায ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার।
ছাগলনাইয়াতে বাড়িঘরে ক্ষতি ২০০ কোটি টাকা
ভয়াবহ বন্যায় ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঁচ ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা এলাকায় অন্তত ২০ হাজার ৫০০টি বসতঘর পানিতে তালিয়ে যায়। এতে আনুমানিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০৫ কোটি টাকা বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা। ক্ষতিগ্রস্ত বসতির মধ্যে দালানঘর, সেমিপাকা, টিনশেড ও মাটির ঘর রয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া বসতঘরের অন্তত ৯০ শতাংশের আসবাবপত্র মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বন্যার পানিতে পাঠাননগর ইউনিয়নে অন্তত ৫ হাজার, রাধানগর ইউনিয়নে ৫ হাজার, শুভপুর ইউনিয়নে ৩ হাজার, ঘোপাল ইউনিয়নে ৩ হাজার, পৌর এলাকায় ২ হাজার ৫০০ এবং মহামায়া ইউনিয়নে ২ হাজার বসতঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সহায়তা পেতে আবেদন করতে বলা হয়েছে।
ছাগলনাইয়ার বাসিন্দা রায়হান উদ্দিন জানান, বন্যার প্রবল স্রোতে তার পাকা দালানের পেছনের অংশ ধসে পড়েছে। মেরামতে ব্যয় হবে সাড়ে ৬ লাখ টাকা। বাড়িঘর ডুবে আসবাবপত্রও নষ্ট হয়েছে বলে জানান তিনি।
ছাগলনাইয়া উপজেলা পরিসংখ্যান অফিসের তথ্যমতে, সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ছাগলনাইয়া উপজেলার মোট ঘরের সংখ্যা ৪৯ হাজার ৫৭৮টি। এর মধ্যে পাঠাননগর ইউনিয়নে ১৪ হাজার ৭৮টি, পৌরসভায় ৮ হাজার ৮৩৯টি, শুভপুর ইউনিয়নে ৭ হাজার ৩২২টি, মহামায়া ইউনিয়নে ৬ হাজার ৬৪০টি, রাধানগর ইউনিয়নে ৬ হাজার ৪৪০টি এবং ঘোপাল ইউনিয়নে মোট ঘরের সংখ্যা ৬ হাজার ২৫৯টি।
পরশুরামে বাড়িঘরে ক্ষতি প্রায় ১৫০ কোটি টাকা
এবারের বন্যায় পরশুরামে আনুমানিক ১৫ হাজার পরিবারের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ২০০ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা।
বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের উত্তর টেটেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা লোকমান হোসেনের বাড়ি কহুয়া নদীর পাশে। বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে তার বসত বাড়ি ও রান্নাঘর। তিনি বলছেন, ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮ লাখ টাকা।
চিথলিয়া ইউনিয়নের উত্তর শালধর গ্রামের মিহির দাশ কৃষ্ণ জানান, বন্যায় ঘরে পানি প্রবেশ করে দুইটি বৈদ্যুতিক মোটর অকেজো হয়ে গেছে। আসবাবপত্রসহ প্রায় ২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
মির্জানগর ইউনিয়নের মির্জানগর গ্রামের রাকিব হোসেন জানান, ২০ আগস্ট রাতে হঠাৎ ঘরে পানি ঢুকতে শুরু করে। এক বুক পানি নিয়ে ঘর ছেড়ে প্রতিবেশির বাড়ির ছাদে উঠি। ঘরে থাকা মোটর, ফ্রিজ ও আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় ১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
একই ইউনিয়নের মনিপুর গ্রামের সাইফুল ইসলাম সুমন জানান, বন্যার পানিতে ঘরের টিন, ঘরের বেড়া, টয়লেট ভেসে গেছে। আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ দেড় লাখ টাকার মতো। একইভাবে সর্বনিম্ন ১৫ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১২ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতির কথা বলেছেন ভুক্তভোগীরা।
২০২২ সালের জনশুমারি তথ্য অনুযায়ী, পরশুরাম উপজেলায় পরিবারের সংখ্যা ২৫ হাজার ৯৩৭টি।
ফুলগাজীতে ক্ষতি প্রায় ২৪৭ কোটি টাকা
ভয়াবহ বন্যায় ফেনীর উত্তরের জনপদ ফুলগাজীর ৬ ইউনিয়নে বসতঘরের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। উপজেলায় ২৮ হাজারেরও বেশি পরিবারের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ ঘর বন্যা কবলিত হয়। আনুমানিক ২৪ হাজার ৭৮৭ পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই পরিবারগুলোর সব ধরনের আসবাবপত্র ব্যাপকভাবে ক্ষতি হয়েছে। ভুক্তভোগীদের তথ্যানুযায়ী টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২৪৭ কোটি টাকা।
স্থানীয়রা জানান, ফুলগাজী ইউনিয়নে প্রায় ৭ হাজার ৫০টি ঘর, মুন্সীরহাট ইউনিয়নে ৪ হাজার ৫৯৫টি, দরবারপুর ইউনিয়নে ৩ হাজার ৪৫৪টি, আনন্দপুর ইউনিয়নে ২ হাজার ৮২২টি, আমজাদহাট ইউনিয়নে ৪ হাজার ১৮৮টি এবং জিএমহাট ইউনিয়নে ২ হাজার ৬৮৭টি বসতঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়।
ফুলগাজী উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে মোট গ্রাম ৮৭টি। তন্মধ্যে ফুলগাজী সদরে ২৪, মুন্সীরহাটে ২১, দরবারপুরে ৯ আনন্দপুর ১৩ আমজাদহাটে ১২ ও জিএমহাট ইউনিয়নে ৮টি গ্রাম রয়েছে।
আনন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (সচিব) ফজলুর রহমান প্রেরিত তথ্যমতে, ইউপি দপ্তরের আনুমানিক ক্ষতি ৪ লাখ টাকা।
সরেজমিনে দরবারপুর ইউনিয়নের জগতপুর, বসন্তপুর, উত্তর শ্রীপুর, ধলিয়া, ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের নিলক্ষী, গাবতলা, বাসুড়া, উত্তর ও দক্ষিণ দৌলতপুর, আমজাদহাট ইউনিয়নের উত্তর ধর্মপুর, জিএমহাট ইউনিয়নের বশিকপুর ও মুন্সীরহাট ইউনিয়নের দঃ শ্রীপুর, দঃ তারালিয়া, নোয়াপুর, কামাল্লা, বদরপুর, করইয়া পৈথারা গ্রামের বাড়ীঘর দেখে বিধ্বস্ত জনপদের চিত্র ফুটে উঠেছে। মাটির ঘর সম্পূর্ণভাবে ভূমিতে মিশে গেছে। মুন্সীরহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ তারালিয়া, পৈথারা গ্রামের মাটির ঘর সম্পূর্ণভাবে ভূমিতে মিশে গেছে।
দক্ষিণ তারালিয়া গ্রামের বাসিন্দা জিএমহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাজী আফসার উদ্দিনের বসত ভিটা গুদামঘর সম্পূর্ণ রূপে মাটিতে মিশে গেছে বলে জানান। একই গ্রামের আমিনুল হক চৌধুরী মঞ্জু, ছবুরা খাতুন, আবদুল আউয়াল, সাগর, কৃষক নুরুল ইসলাম, নুরুন নবী, হাসেম মিয়া, আজাদের এমন আরো ৯টি মাটির ঘর সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে।
একই চিত্র কমুয়া গ্রামের ইসমাইল হোসেন পাটোয়ারী টিপু, সীমান্তবর্তী পৈথারা গ্রামের অবস্থাও শোচনীয় আকার ধারণ করে। মুন্সীরহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীপুর গ্রামের মোতালেব, সফিক, আবু তাহের, জামাল, জোৎস্না বেগমের ঘর বিলীন হয়ে গেছে। সূত্র: বার্তা২৪
চস/স