spot_img

২৬শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, শুক্রবার
১০ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সর্বশেষ

একটি সফলতা বা অসফলতার গল্প!

নারীর সফলতার গল্প নিয়ে ভাবছিলাম। জীবনের অর্ধেকটা সময় পার করে এসে আসলে নিজেই দ্বিধা-দ্বন্দে থাকি আমি কি সফল?

পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষ সফলতার গল্পের উদাহরণ হিসেবে চিন্তা করেন একজন তার কর্মজীবনে কতটা সফল তা দিয়ে।

একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে কতটা সফল, একজন ব্যবসা করে কতটা সফল, একজন চাকুরী করে কতটা সফল, এসবের গল্পই আমরা টিভি, পত্রিকায় দেখতে পাই!

তো সেই মানদন্ডে আমার কোন সফলতার গল্প নেই, আমার ধারণা ৮০% নারীরই নেই! তাহলে তারা কি অ-সফল?

একটা নারী কতটা শারীরিক- মানসিক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে একজন মা হয়, নিজের স্বপ্ন, শখ-আহ্লাদকে কি পরিমান জলাঞ্জলি দিয়ে একজন গৃহিণী হয়ে ওঠে এসব গল্প কি কখনও আমরা শুনেছি? শুনিনি!

আমি না হয় তেমন একটা বিষন্ন গল্প নিয়েই আসলাম!

পড়াশোনা শেষ করে চিরন্তন নিয়মে বিয়ের পিড়িতে বসলাম তবে প্রচন্ডভাবে ইচ্ছা ছিলো পড়াশোনাকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাবো! স্বাবলম্বী হবো, নিজের হাত খরচ নিজেই চালাবো!

হ্যা বিয়ের পর স্বামীর সহযোগিতায় চাকুরী করা শুরু করলাম! বেতন খুব মোটা অংকের না হলেও খারাপ ছিলনা!

সময়ের সাথে সাথে সেটা বেড়ে বেশ সম্মানজনক একটা অংকে দাড়ালো, সেটা এখন পর্যন্ত কন্টিনিউ থাকলো তাকে অবশ্যই মোটা অংকের বলা যেত। বলতে পারতাম আমার ২৪ ঘন্টার মাত্র ৮ ঘন্টা সময় দিয়ে মোটা অংকের বেতন পাই!

কিন্তু না তিন বছরের মাথায় দুজন থেকে তিনজন হলাম। দুজনের সংসার হওয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সন্তানকে নিজের সবটুকু দেওয়ার নিমিত্তে চাকরি ছাড়লাম।

সন্তানকে বড় করা নিমিত্তে অনেক মাকেই নিজের পেশা ছেড়ে গৃহিণী হতে হয়

কারণ খুব কাছ থেকে কয়েকজন কর্মজীবি মায়েদের দেখেছি, যাদের সন্তান কতটা একাকীত্ব বা বৈরিতার মধ্যে দিয়ে বড় হয়। তখন থেকে মনেপ্রাণে শপথ করেছিলাম সন্তানকে আমার ১০০% দিতে চেষ্টা করবো!

আমি মোটেও কর্মজীবী মায়েদের ছোট করে দেখছিনা যাদের সুযোগ আছে, পর্যাপ্ত মনোবল আছে তাদেরকে আমি সবসময় উৎসাহিত করি কিছু একটা করার জন্য।

কর্মজীবী মেয়ে/মা বা নারীকে বরং অনেক বেশী সম্মান করি কারণ তাদের যুদ্ধটা আরো বেশী, তাদের যুদ্ধটা ঘরে-বাইরের দু জায়গারই!

আরো পড়ুন: নিয়মিত ২০ মিনিটের ব্যায়ামে আসবে প্রশান্তির ঘুম

আমার সুযোগ ছিলোনা নামের আগে কর্মজীবী কথাটা সেঁটে রাখার! কারণ ভরসা করার মত কেউ ছিলোনা বা নেই। তবে এ জায়গাটাতে আমি একটু সেঁকেলে হয়তো, কাজের মানুষের কাছে বাচ্চা রেখে কাজ করার ইচ্ছে আমার কোনদিন ছিলো না!
তাই ছেড়ে দিলাম।

আমার ছেলের যখন দেড় বছর বয়স তখন থেকে হঠাৎ করে আমার প্রচন্ড কোমর ব্যাথা শুরু হয়। ডাক্তার দেখালাম। নানারকম টেস্ট করে জানা গেল আমার মেরুদন্ডের শেষের তিনটা ডিস্ক একদম স্ট্রেইট হয়ে গেছে, ডিস্ক তার স্বাভাবিক ফ্লেক্সিবিলিটি হারিয়েছে! সাথে সিজারের এনেস্থিসিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কাজ করেছে!

কারণ হিসেবে জানা গেলো, দিনের অনেকটা সময় জুড়ে বাচ্চাকে বসে ব্রেস্ট ফিডিং করানোর ফল এটা। নতুন মা ছিলাম ডাক্তার বলেছিলেন, বাচ্চাকে বসে খাওয়ানোর জন্য। দেড় বছর পর্যন্ত রাতেও বসে খাওয়াতাম উঠিয়ে!

যাই হোক চিকিৎসা হিসেবে ফিজিওথেরাপি চললো টানা ১ মাস, আর সাথে বসে সব ধরণের কাজ পরিহার করা সহ একগাদা এক্সারসাইজ!

ঠিক ঐ সময় আমার শ্বাশুড়ি মায়ের একটা মেজর অপারেশন হলো। অপারেশন এর রোগী আমার কাছে।
আমি টানা ২ ঘন্টা থেরাপি নিয়ে এসেই দৌড়াতাম রান্নাঘরে।
ছোট বাচ্চা, বিছানায় অসুস্থ মা তার পানির গ্লাসটাও বিছানায় দিতে হয়, সাথে আমার ভাঙা মেরুদন্ড। না থেমে থাকিনি, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি সবকিছু সফলতার সাথে করতে।
কষ্ট হয়েছে, একা রুমে কেঁদেছি, রুম থেকে বের হয়েছি হাসি মুখে। আমার কান্না যেন কাওকে না ছুঁতে পারে।

এরমধ্যে ১ বছর পর্যন্ত ৩ মাস পরপর ১ মাস করে আমার থেরাপি নিতে হয়েছে। কোমর ব্যাথা একটু কনট্রোলে আসলো কিন্তু হাঁটুতে সমস্যা দেখা দিলো! সবকিছু দাড়িয়ে করতে করতে পায়ের উপর প্রেশার গেছে।
মাসলগুলো প্রচন্ড উইক আর হাঁটুর দুই ডিস্কের মাঝের গ্যাপটা কমে গেলো।

আবার শুরু থেরাপি। এরমধ্যে হঠাৎ করে শুরু হলো এলবো পেইন, ডাক্তারের ভাষায় গলফারস এলবো। হাতের উপরে অতিরিক্ত প্রেশারের কারণে যেটা হয়। কিন্তু আমার কি কারণে হলো? কারণ দেখা গেলো, আমার কিছু এক্সারসাইজ করতে হতো যেগুলাতে হাতের উপর প্রেশার পড়ে!

এভাবে সেই থেকে চলছে থেরাপী ৬/৭ মাস পরপর। কখনও পায়ে, কখনও কোমরে, কখনও হাতে, কখনও বা সব একসাথে!

শুধু এসবে শেষ না। আছে ক্রনিক সাইনাস আর মাইগ্রেন। এগুলা আমাকে মাঝেমাঝে হসপিটাল পর্যন্তও টেনে নেয়, ব্যাথা+ ঘুমের ইঞ্জেকশান নেয়ার পর থামে!

মোটকথা শরীরের ভেতরটা পুরাই মরিচা পড়া, ভাঙা চোরা পার্টস আর উপরে চকচকে কাভার নিয়ে দৌড়াচ্ছি প্রতিনিয়ত।

এতকিছুর মাঝেও কোন দায়িত্ব-কর্তব্য, নিজের টুকটাক শখ কোন কিছুকে না বলিনি কখনও!

টুকটাক অনলাইন বিজনেস চালাই, রান্না করতে ভালোবাসি, ফটোগ্রাফি/ফুড ফটোগ্রাফি করতে ভালোবাসি, টুকটাক লেখা লেখি করি। এসব যে পার্ফেক্টলি করি তা নয় তবে এগুলো আমার মনের খাবার, মন চায় বলে করি!

একজন ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার সফলতার সাথে শুরু করেও মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছি, পরিবারকে সবটুকু দেয়ার নিমিত্তে।

মা বা গৃহিণী হিসেবে সফল কতটুকু জানিনা তবে নিজেকে নিজে সফল মনে করি তখন যখন বুজতে পারি শশুরবাড়ির সবার কাছে ভরসার নাম হতে পেরেছি বা তাদের প্রশংসা বাক্য আর ভালোবাসায় সিক্ত হই, আলহামদুলিল্লাহ!

এসবের পরও প্রায়ই যে কথাটার সম্মুখীন হই সেটা হলো ‘কিছু করেন না?
বাধ্য হয়ে মনের বিরুদ্ধে অনেক সময় উত্তর দিতে হয়, ‘করিনা’!

২৪ ঘন্টার ১৮ ঘন্টা সংসারে দেই তারপরও সিল লেগে গেছে ‘কিছু করিনা’!
শুধু আমি কেন প্রতিটি গৃহিনী/ মায়ের গায়ে এ সিল যারা চাকরি করেনা!

কি অদ্ভুত একজন মানুষ যে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত প্রায় ১৮ ঘন্টা সংসারের প্রতিটা মানুষের জন্য করে যাচ্ছে সে নাকি কিছু করেনা!

সকালে পরিবারের প্রতিটা মানুষের নাস্তা, বাচ্চাদের স্কুলের টিফিন, স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসা, বাজার করা, সারাদিনে পরিবারের সদস্যদের পেট পূজার আয়োজন করা, থালা বাসন পরিষ্কার করা, ঘরদোর পরিষ্কার – পরিচ্ছন্ন করা, বাচ্চাদের পড়াশোনা তদারকি করা, অতঃপর ঘুমাতে গিয়েও চিন্তা করা সকালের নাস্তা কি হবে,বাচ্চার টিফিন কি হবে, সারাদিনের রান্না কি হবে!

এতকিছুর পরও অনেকে সহানুভূতির সহিত জানতে চান ঐ মানুষটির কাছে, ‘কিছু করেন না’? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হয়তো তাকে উত্তর দিতে হয়, ‘নাহ! করিনা! ‘

কেন এ উত্তর? আমার প্রচন্ড আপত্তি ‘কিছু করিনা’ এ কথাটা বলতে! মেয়ে তুমি গলা উচু করে বলো, হ্যা আমি করি! আমার পরিবারের জন্য যা কিছু ভালো তার সব আমি করি! আমার ২৪ ঘন্টার ১৮ ঘন্টার সর্বোচ্চ ইফোর্ট আমি আমার সন্তান আমার পরিবারকে দেই!

বছরে একটা নারী দিবস পালনের কি মাহাত্ম্য? ওটা শুধু পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ! যতদিন না আমরা নিজেকে মানুষ হিসাবে সম্মান করতে পারবো। যতদিন না আমরা নারী হয়ে অন্য নারীকে সম্মান না করতে পারবো!

আর হ্যালো পুরুষ আপনাদের বলছি, একটা মেয়ের ২০-২২ বছরের স্বপ্নকে বুকের কোনে কবর দিয়ে ভালোবেসেই তার কাঁধে তুলে নেয় তার সন্তান বা পরিবারের সদস্যদের দেখভালের কাজ। তার কাজকে সম্মান করুন!

কেউ চাকুরী করেনা বলে তার ঘর সংসারের কাজকে ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই।

সংসারের নারী সদস্যের কাজের সামান্য ভুল ত্রুটি হলে আশেপাশে অনেক পুরুষকে বলতে শুনেছি, ‘সারাদিন ঘরে কি করো অ্যা, এটুকু কাজ ঠিকমত করতে পারোনা!’

ছোট খাটো ভুল ত্রুটি হতেই পারে অবজ্ঞা না করে, সহমর্মী হোন!

একবার ভাবুন তো আপনার স্ত্রী/মা তার ১৮ ঘন্টা কাজের বিনিময়ে যদি আপনার কাছে মোটা অংকের টাকা দাবী করে তাহলে কি হবে?

না তারা তা চান না! চান একটু সম্মান, সহানুভূতি, সহমর্মীতা!
সেটুকুই দিন দেখবেন ভালোবাসায় ভরে উঠেছে আপনার চারপাশটা!

নারী দিবস বলে যদি আজ দুজন পুরুষকে ধন্যবাদ না দেই তাহলে অকৃতজ্ঞ এর কাতারে পড়ে যাবো।
বাবা আর আমার স্বামী, দুইটি মানুষ জীবনে না থাকলে কোনভাবেই হয়তো আজ এই আমার অস্তিত্ব থাকতোনা।

চস/সোহাগ

Latest Posts

spot_imgspot_img

Don't Miss