উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষার পর প্রতিটি শিক্ষার্থীরই একটি স্বপ্ন থাকে ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া। অনেকেই এই লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে ভর্তি হন কোচিং সেন্টারে। নিজেদের প্রস্তুত করেন প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার জন্য। কিন্তু এই চিত্রটি সবার জন্য সমান নয়। মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়া অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সংসারের খরচ চালাতে যেখানে পরিবার হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে অতিরিক্ত কোচিংয়ের খরচ বহন করা তাদের জন্য কঠিন। ফলে তারা ইচ্ছা থাকলেও পূর্ণ প্রস্তুতির সুযোগ পান না। এ অবস্থায় কেউ কেউ বাড়িতে বসেই নিজ উদ্যোগে প্রস্তুতি নেন এবং ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তবে কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় হতাশা এসে ভর করে।
এই বাস্তবতা থেকে অনেক শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কেই তাদের অগ্রাধিকার হিসেবে বেছে নেন। কারণ এটি তুলনামূলকভাবে কম খরচে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের একটি সুযোগ করে দেয় এবং অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার সুবিধাও থাকে। এইভাবে শিক্ষার্থীরা তাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই পথ খুঁজে নেন, আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্ববৃহৎ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর অধিভুক্ত দুই হাজারেরও বেশি কলেজে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চশিক্ষার প্রায় সত্তর শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় পরিচালিত হয়। ফলে উচ্চশিক্ষার বড় একটি দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানের কাঁধে বর্তায়। এই বিশাল দায়িত্বের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির কাঠামো ও ব্যবস্থাপনাগত দিক নিয়ে প্রশ্ন উঠছে দীর্ঘদিন ধরেই। একদিকে বিশাল শিক্ষার্থী সংখ্যা, অন্যদিকে অবকাঠামো; এই দুইয়ের মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখা বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। ফলে প্রশাসনিক জটিলতা, ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতা এবং শিক্ষা কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা দেখা যায়।
বর্তমানে শিক্ষক সংকট ও প্রশিক্ষণের অভাব একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বহু কলেজ, বিশেষ করে দূরবর্তী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত স্থায়ী শিক্ষক নেই। গুটিকয়েক শিক্ষকের উপর পড়ে থাকে বিপুল দায়িত্ব। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনার্স পর্যায়ের পাঠদান পর্যন্ত গেস্ট টিচারের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। অথচ এই স্তরের শিক্ষার জন্য অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত ও পূর্ণকালীন শিক্ষকের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এই অব্যবস্থার কারণে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞানের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক কলেজে লক্ষ্য থাকে শুধু ক্লাস সংখ্যা পূরণে, শিক্ষার মান উন্নয়নে নয়। এর ফল হিসেবে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক অর্জন আশানুরূপ হয় না, যা ভবিষ্যতের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এর পাশাপাশি আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হলো সেশনজট। একটি চার বছরের অনার্স কোর্স শেষ করতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীর ছয় থেকে আট বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব, পরীক্ষা নির্ধারণে জটিলতা, প্রশাসনিক কার্যক্রমের ধীরগতি, সবকিছু মিলিয়ে এই সমস্যা দিন দিন জটিলতর হয়েছে। সেশনজট শুধু শিক্ষাজীবনকে বিলম্বিত করে না, বরং কর্মজীবনেও প্রভাব ফেলে। সরকারি চাকরির বয়সসীমা অতিক্রম করে যাওয়া, উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হতে না পারা এবং পারিবারিক চাপে পড়ে অনেকের স্বপ্ন মাঝপথেই থেমে যায়। এই চাপ সবচেয়ে বেশি টের পায় মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম ও সিলেবাস নিয়েও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এখনো পুরনো সিলেবাস চালু রয়েছে, যা বর্তমান সময়ের চাহিদা ও চাকরির বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রযুক্তির বিকাশ, কর্পোরেট বাস্তবতা কিংবা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড, কোনোটির প্রতিফলন এতে তেমন নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেও পিছিয়ে পড়ছে একটি গতানুগতিক কাঠামোর মাঝে। পাঠ্যক্রমে আধুনিকতা বা বিষয়বৈচিত্র্য নেই বললেই চলে। অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন বা ভাইভার মতো আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতির চর্চা না থাকায় শিক্ষার্থীরা বিশ্লেষণমূলক চিন্তা, গবেষণার প্রবণতা কিংবা নিজেকে উপস্থাপনের সক্ষমতা অর্জনে পিছিয়ে থাকে। এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ একজন শিক্ষার্থীকে কেবল ভালো শিক্ষার্থী নয়, বরং একজন দক্ষ পেশাজীবী হিসেবে গড়ে তোলে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো উপেক্ষিত থাকে, যার প্রতিক্রিয়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে, প্রশাসনিক স্বচ্ছতার অভাব ও দুর্নীতির অভিযোগও বহুদিনের। ভর্তি কার্যক্রম, ফরম ফিলাপ-এ অতিরিক্ত ফি আদায়, এ নিয়ে নানা সময় আলোচনার সৃষ্টি হলেও বাস্তবে এর স্থায়ী সমাধান দেখা যায় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর পর একটি মাত্র ভাইভা নেওয়া হয়, যেটি একাডেমিক জীবনের শেষ পর্বে আসে। অথচ বিভিন্ন বিষয়ে সাবজেক্টভিত্তিক বা বর্ষশেষে ভাইভা চালু থাকলে শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি বাস্তবভিত্তিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারত। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে এসব কার্যক্রম নিয়মিত চালু রেখেছে, সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দিকটি থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকে কেন্দ্র করে কিছু বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনার চিত্র স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে, বিশেষত উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের ক্ষেত্রে। যেখানে আগে সাবজেক্ট প্রতি নির্ধারিত ফি ছিল ৮০০ টাকা, এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১২০০ টাকা। যদিও যুক্তি হিসেবে বলা হয়, এখন শুধু রিকাউন্ট নয় বরং সম্পূর্ণ খাতা নতুনভাবে মূল্যায়ন করা হয়, তবুও এই বাড়তি অর্থ শিক্ষার্থীদের সবার সাধ্যের মধ্যে পড়ে না। এটি শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্ত বলে মনে হয় না। বরং এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া যেন সবার জন্য সহজলভ্য থাকে, সে দিকেই কর্তৃপক্ষের মনোযোগ দেয়া উচিত।
একটি সেশনের পরীক্ষার ফল প্রকাশে চার থেকে পাঁচ মাস সময় লেগে যায়, যার ফলে ফল প্রকাশের পরপরই পরবর্তী ফরম পূরণ শুরু হয়। কেউ কোনো বিষয়ে অকৃতকার্য হলে, সে যথাযথ প্রস্তুতির সুযোগ পায় না। উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের ফলও শেষ মুহূর্তে দেওয়া হয়। দু’টো ফলাফল প্রকাশে ভারসাম্য বজায় রাখা অতি গুরুত্বপূর্ণ। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ধরণের বিলম্ব শিক্ষার্থীদের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করে, যা অনেকের জন্য মানসিকভাবে কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এক অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছেন, ‘পুনর্মূল্যায়নে ৫৪ শতাংশ ফল পরিবর্তন হয়েছে। এটি একটি উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান।’ এতে প্রশ্ন ওঠে, পূর্বে কত শিক্ষার্থী প্রকৃত ফলাফলের বাইরে থেকে গেছে কিংবা ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই দিকটি অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত।
ফলাফলের গুণগত মান নিয়েও রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। বহু শিক্ষার্থী আশানুরূপ ফল না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়। অনেক সময় একাধিকবার ইম্প্রুভমেন্ট পরীক্ষা দিলেও এমন হয় যে, একজন শিক্ষার্থী ভালো প্রস্তুতি নিয়েও কাঙ্ক্ষিত গ্রেড পায় না, অকৃতকার্য হন। এতে করে তার আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয় এবং একাডেমিক জীবনে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেকের শিক্ষাজীবনই থমকে যায়! এমনকি শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে আলাদা তেমন কোনো ক্লাব বা সেমিনার নেই। ইংরেজি ভাষা চর্চার জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগ বা ক্লাব না থাকায় শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দুর্বলতা দূর হয় না। এর ফলে কর্মজীবনের প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে পড়ে। এছাড়া ফলাফল জালিয়াতি নিয়ে অভিযোগও বেশ পুরনো। প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে ফলাফল পরিবর্তনের ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে। এই ধরণের দুর্নীতি রোধে কর্তৃপক্ষকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। শিক্ষার ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এই বিষয়গুলো উপেক্ষা করার একদমই সুযোগ নেই।
গবেষণার ক্ষেত্রেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। অথচ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল শক্তির একটি দিক হলো গবেষণা। এ ঘাটতি উচ্চশিক্ষার মানকে প্রভাবিত করে এবং সামগ্রিকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অবদান রাখাকে বাধাগ্রস্ত করে। ব্যক্তিগত ভাবে মনে করছি, সর্ববৃহৎ ভাবে পরিচালিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমে তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণের জায়গা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশাল কাঠামো পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট মনিটরিং ব্যবস্থা থাকা জরুরি, যেখানে দায়িত্বশীল, অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের নিয়ে আলাদা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পৃথক শিক্ষা কমিশন গঠন করে সার্বিক মান উন্নয়নে বিশেষ নজর দেয়া উচিত। ভর্তি পরীক্ষায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও এই ব্যবস্থার অংশ হতে পারে। তবেই ধাপে ধাপে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব হবে। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বলা যায়, সঠিক নীতিমালা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আরও কার্যকর ও গুণগত শিক্ষা প্রদানে সক্ষম হবে। এই বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন প্রশাসনিক সংস্কার, স্বচ্ছতা এবং শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার অন্যতম চালিকাশক্তি। তাই এর উন্নয়ন মানেই দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন।
বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ (দায়িত্বগ্রহণ আগস্ট ২০২৪) কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন এবং তাঁর প্রশাসন সে অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু করেছে।
পুরনো সিলেবাস পুনর্বিবেচনা করে কর্মমুখী ও আধুনিক পাঠ্যক্রম চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়গুলোকে বাধ্যতামূলক করে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান সমন্বয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চাকরি-বান্ধব দক্ষতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালকে “পরীক্ষা বর্ষ” ঘোষণা করে একাধিক সেশন একত্রে গ্রহণের মাধ্যমে সেশনজট ৭০–৮০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যে কার্যক্রম চলছে। সরকারি কলেজে শিক্ষক নিয়োগ এবং বেসরকারি কলেজের (অ-এমপিও) শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, গবেষণার পদ্ধতি ও পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছে। ভিজিল্যান্স অডিট চালুর মাধ্যমেও শিক্ষকদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পরীক্ষায় নকল রোধে কড়াকড়ি আরোপ এবং কেন্দ্রগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধির মাধ্যমে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। নকলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নৈতিকতার ক্ষতিতে পড়ে, তাই এই কঠোরতা সময়োপযোগী। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করাও এই প্রক্রিয়ার অংশ। শিক্ষকদের মর্যাদা ও মান উন্নয়নের পাশাপাশি চাকরি সংবিধি সংশোধন করে ২৫ বছর পূর্ণ হওয়া শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের ঐচ্ছিক অবসরের বিধান চালু করা হয়েছে, যা সিন্ডিকেট ও বিশেষ সিনেট অধিবেশনে অনুমোদিত হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯২ সালে। দীর্ঘ ৩৩ বছরে মাত্র একবার সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। লক্ষ লক্ষ গ্র্যাজুয়েট তাদের প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। দ্বিতীয় সমাবর্তন খুব শীঘ্রই আয়োজন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম ৬০% উপস্থিতি ও ইনকোর্স পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে পেপার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা আরও স্বচ্ছতা ও মান নিশ্চিত করবে। শিক্ষার্থীদের সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে ‘ডাবল এক্সামিনেশন’ সিস্টেম পুনরায় চালুকরণ। বিশেষকরে ইংরেজি ও আইসিটি বাধ্যতামূলক। একজন শিক্ষার্থীর যদি ইংরেজিতে দক্ষতা না থাকে কিংবা প্রযুক্তি বিষয়ে যথাযথ ধারণা না থাকে, তাহলে বর্তমান যুগে সে অনিবার্যভাবেই পিছিয়ে পড়বে। এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আরও যোগ্য করে তুলবে।
বর্তমান উপাচার্যের চিন্তাভাবনা যুগোপযোগী ও বাস্তবমুখী। ঘোষিত সংস্কারগুলোর কতটুকু বাস্তবায়ন হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়ন এবং কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের আস্থা ধরে রাখতে এবং “বেকারের বিশ্ববিদ্যালয়” অপবাদ ঘোচাতে এখনই সময় উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি উদার্থ আহ্বান থাকবে, সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাকে যেন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। বিশেষ করে মফস্বলের কলেজগুলোতে ভর্তি, ফরম ফিলাপ বা অন্যান্য একাডেমিক কার্যক্রমে অতিরিক্ত ফি আদায়ের প্রবণতা যেন বন্ধ হয়। কারণ এসব ফি একজন দরিদ্র শিক্ষার্থীর পক্ষে বহন করা অত্যন্ত কষ্টকর। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেন কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানে যুক্ত হতে পারে, সেই লক্ষ্যেই নেওয়া উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন সময়োপযোগী ও জরুরি।
বিলম্বিত পরীক্ষা ও ফলাফল, গবেষণার সীমাবদ্ধতা, শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা ও চাকরির বাজারে গ্রহণযোগ্যতা, এসব সমস্যা আজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে ভূতুরে রেজাল্ট ব্যবস্থা পরিবর্তন এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
লেখক : শিক্ষার্থী, ভোলা সরকারি কলেজ