spot_img

২৫শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, শুক্রবার
১০ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বি এম আতিকুজ্জামান

সর্বশেষ

চোখের আলোয়

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে তখন সন্ধ্যা নামছে। “সন্ধানী” রক্তদানের সংগঠনের অফিসে আমি বসে আছি রতন ভাইয়ের সঙ্গে। রতন ভাই আমাদের গাইড করেন— কীভাবে রক্তদানের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হয়, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়, সেসব বোঝাচ্ছেন।

ঠিক তখনই দরজায় দেখা গেল এক অচেনা যুবককে। রোগা-পাতলা গড়ন। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ে পুরনো চেকের ফ্লানেলের শার্ট, পরনে খাকি প্যান্ট। পায়ে মোজা পরা, সাথে চপ্পল। হাতে কয়েকটা পুরোনো বই। শরীরে কেমন এক ক্লান্তি ঝুলে আছে। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“সন্ধানীর পরবর্তী রক্তদান কর্মসূচি কবে, কোথায়?”

আমি বললাম, “আমরা শিগগিরই জানাবো।” তিনি মৃদু মাথা নেড়ে একটু বসে পড়লেন। তারপর চুপচাপ উঠে চলে গেলেন।

তার যাওয়ার পর রতন ভাই বললেন,
“উনি আবদুল্লাহ ভাই। খুব ভালো মানুষ। কিন্তু… উনার এক জটিল অসুখ আছে। বেশিদিন বাঁচবেন না।”
আমি থমকে গেলাম। এই তো সদ্য দেখলাম তাঁকে, একটু আগেই কথা হলো। এত স্বাভাবিক, অথচ তাঁর জীবন গুটিয়ে আসছে?

কদিন পর খবর এল— আবদুল্লাহ ভাই আবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শুনলাম, মাঝে মাঝেই তাঁর শরীর খারাপ হয়, তখন হাসপাতালে আসেন। ভালো বোধ করলেই চলে যান।

আমি দেখতে গেলাম তাকে। তিনি তখন স্টুডেন্ট ওয়ার্ডের এক বেডে বসে আছেন। গায়ে লাল কম্বল। হাতে স্যুপের বাটি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন,
“এই সুপটা বাসা থেকে এসেছে। আর, এই নাও, কমলা খাও।”
আমি হেসে বললাম, “না ভাই, আপনি খেয়ে নিন। পরে খাবো।”

তিনি তখন আরও মলিন দেখাচ্ছিলেন। চোখে গভীর শান্তি, কিন্তু ক্লান্তি স্পষ্ট। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
“আমি মরণোত্তর চক্ষু দান করে দিয়েছি।”

আমি কিছু বলতে পারলাম না। শুধু তাকিয়ে রইলাম। মাথার ভেতর কেমন ঘুরপাক খেতে লাগল কথা গুলো।
ফিরে এসে হোস্টেলে মন খারাপ হয়ে গেল। কী অদ্ভুত এক মানুষ! জীবনকে ধরে রাখতে না পারলেও, মৃত্যুর পর কাউকে আলো দেবার কথা ভাবছেন!

সত্যিই, কিছুদিন পর শুনলাম— তিনি আর নেই। ঘুমের মধ্যেই পৃথিবী থেকে চলে গেছেন।
সেদিন আমাদের ক্লাস বাতিল হলো। তাঁর প্রথম জানাজা হলো মেডিকেল কলেজের মসজিদে। এত মানুষ জড়ো হয়েছিল যে জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না।

জানাজার পর আমি একা একা হেঁটে বেড়ালাম পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে। কেমন ফাঁকা, কেমন নিঃস্তব্ধ লাগছিল সব। যেন কিছু নেই। অথচ ঠিক কী নেই, তা বোঝা যাচ্ছিল না।
পরদিন শুনলাম, আবদুল্লাহ ভাই তাঁর কর্নিয়া দান করে গেছেন। একটি ছোট্ট মেয়ে, যে কিছুই দেখতে পেত না— এখন দেখতে পায়। ওর চোখে এখন পৃথিবীটা জ্বলজ্বল করে ওঠে।

কিছুদিন পর “সন্ধানী”র কেন্দ্রীয় সম্মেলন হলো আমাদের কলেজে। আমি ছিলাম উপস্থাপক। অনুষ্ঠান শুরু হতেই বাঁশির মৃদু সুর ভেসে এলো। মঞ্চে আলো জ্বলে উঠল। দেখা গেল, এক ছোট মেয়ে একা বসে আছে সামনে।
আমি মঞ্চের আড়াল থেকে বললাম,

“এই মেয়েটি আজ আপনাদের দেখতে পাচ্ছে। পৃথিবীর আলো, সবুজ পাতা, নীল আকাশ, প্রিয়জনের মুখ— সব দেখতে পাচ্ছে। এই আলো, এই দৃষ্টি এসেছে আবদুল্লাহ ভাইয়ের চোখ থেকে।
তিনি হয়তো আজ শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার চোখের আলোয় আজও কেউ নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছে।

তিনি আছেন, আমাদের মাঝেই আছেন— ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণার আলো হয়ে।”
এর কয়েক মাস পর কলেজের মূল প্রবেশপথের নাম রাখা হলো, “আব্দুল্লাহ সরণি”।
এখনও যখন আমরা সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটি, মনের মধ্যে ভেসে ওঠে সেই রোগা, শান্ত মুখটা। মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন—
“চোখ তো থাকবেই না, কিন্তু আলো থাকবে… অন্যের ভেতরে।”

লেখক: আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি চিকিৎসক

Latest Posts

spot_imgspot_img

Don't Miss