৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষা ও উন্নয়নে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি দিতে এবং তাদের পেশাগত অধিকার ও সামাজিক অঙ্গীকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দিবসটি পালন করা হয়। শিক্ষকরা মানবসমাজের আলোকবর্তিকা। শিক্ষক ছাড়া কোনো জাতি উন্নতির পথে এগোতে পারে না। জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানপ্রসারের মাধ্যমেই সভ্যতার বিকাশ ঘটে আর সেই জ্ঞান অর্জনের প্রধান মাধ্যম শিক্ষক। তাই শিক্ষককে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম।
অজ্ঞতার আঁধার মানুষকে পশ্চাৎপদ করে রাখে আর জ্ঞান মানুষকে করে মুক্ত, উন্নত ও মর্যাদাবান। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জাহেলি আরব ছিল এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ। সেখানে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা কয়েকজন। শিক্ষার আলোহীনতার কারণে সমাজে বিরাজ করেছিল হিংসা, ঘৃণা, কুসংস্কার আর অমানবিক আচরণ। এমন এক সময়ে মহান আল্লাহ মানবজাতির উদ্দেশে প্রথম যে নির্দেশ দিলেন, তা হলো জ্ঞান অর্জন। কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ আয়াতেই এসেছে শিক্ষা, কলম আর পাঠের কথা। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিখিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক)
এ ঘোষণার মধ্য দিয়েই মানবসভ্যতার ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ইসলাম জ্ঞানের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে এবং জ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, বরং এক মহান দায়িত্ব ও ইবাদতের সমতুল্য কাজ। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?’ (সুরা জুমার ৯) আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘যাকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়েছে।’ (সুরা বাকারা ২৬৯) এ থেকেই বোঝা যায়, জ্ঞান ও জ্ঞানদাতার মর্যাদা কতটা উচ্চে।
শিক্ষকরা সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ছিল ব্যাপক সমাদৃত। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব শিষ্টাচার শিখো। তাকে সম্মান করো, যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো।’ সুতরাং যার থেকে জ্ঞান অর্জন করা হয় তিনিই আমাদের শিক্ষক। শিক্ষকের মর্যাদায় ইসলামের বক্তব্য ও সংক্ষিপ্ত একটি নমুনা তুলে ধরা হলো, একবার হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু তার সওয়ারিতে ওঠার জন্য রেকাবে (পাদানিতে) পা রাখলেন। তখন ইবনে আব্বাস (রা.) রেকাবটি শক্ত করে ধরেন। হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুলের চাচাতো ভাই! আপনি (রেকাব থেকে) হাত সরান। উত্তরে ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, না। আলেম ও বড়দের সঙ্গে এমন সম্মানসূচক আচরণই করতে হয়।’ জ্ঞানই মানুষের যথার্থ শক্তি ও মুক্তির পথ নির্দেশ দিতে পারে।
হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে বা আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।’ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষা, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষক ও শিক্ষার ব্যাপকীকরণে সদা সচেষ্ট ছিলেন। তাই তো রাসুল (সা.) বদরের যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির জন্য মদিনার শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার চুক্তি করেছিলেন। যার মাধ্যমে তিনি বন্দিদের মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদিন জনৈক বয়স্ক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাজির হলে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম নিজ স্থান থেকে সরে তাকে জায়গা করে দেন। তখন তিনি ইরশাদ করেন, যারা ছোটদের স্নেহ ও বড়দের সম্মান করে না, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়। (জামে তিরমিজি)
ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষকতা অতি সম্মানিত ও মহান পেশা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সামাজিক দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষকতার পেশা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে আমাদের সমাজে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে দেখা যায়। যা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও অমানবিক কাজ। আবার অনেক শিক্ষককে দেখা যায়, শিক্ষকতার এ মহান পেশাকে কলঙ্কিত করে নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত কাজে জড়িয়ে পড়ে, যা অত্যন্ত ঘৃণিত ও বর্জনীয় কাজ। অথচ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছাড়া কেউই আমার আপন নয়।’
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা আজ বড় একটি চ্যালেঞ্জ। একদিকে মানসম্মত শিক্ষক তৈরির সংকট, অন্যদিকে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা কাক্সিক্ষত শিক্ষা পাচ্ছে না। অথচ একটি জাতির অগ্রগতি নির্ভর করে কতটা যোগ্য শিক্ষক সে জাতি তৈরি করতে পেরেছে, তার ওপর। ইসলামে যেমন ভালো শিক্ষক হওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তেমনি শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আজকের দিনে প্রয়োজন, প্রতিটি শিক্ষক যেন আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। নিজের চরিত্র, নৈতিকতা, শিষ্টাচার ও জীবনযাপন দিয়ে তিনি যেন শিক্ষার্থীর কাছে উদাহরণ হয়ে দাঁড়ান। আবার রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব হলো শিক্ষকের যথার্থ মর্যাদা রক্ষা করা, তাদের সঠিক সম্মান ও প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা।
শিক্ষক দিবসের মূল বার্তা হলো, শিক্ষককে সম্মান করা মানে শিক্ষাকে সম্মান করা। ইসলাম যেমন জ্ঞান ও শিক্ষাকে সর্বোচ্চ আসনে স্থান দিয়েছে, তেমনি শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করা মুসলিম সমাজের অন্যতম দায়িত্ব। তাই আজকের দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক, শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে মর্যাদা দিই এবং শিক্ষকের নেতৃত্বে সমাজকে আলোকিত পথে পরিচালিত করি।
আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কথাই বলি। তিনি ছিলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তাকে কত যে লাঞ্ছনা আর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, তা তো সবারই জানা। কিন্তু তিনি পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রেরিত হুকুম-আহকামগুলো মানুষকে শিক্ষা দিতে কখনো পিছপা হননি। জাগতিক কোনো কিছুর জন্য নয় বরং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তিনি আজীবন শিক্ষাদানের কাজটি করে গেছেন। যার ফলে বিশ্ব আজ পেয়েছে শান্তির এক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ইসলাম, যা ইহকাল আর পরকালের শান্তি ও কামিয়াবি লাভের উপায়। তাই বিশ্ব শিক্ষক দিবসের অঙ্গীকার হোক শিক্ষকের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের অঙ্গীকার। আসুন আমরা প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের অনুসরণ করি। শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা দিই। শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করে দুনিয়া ও আখেরাতে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান করুন। আমিন। সূত্র: দেশ রূপান্তর
লেখক : ইমাম, খতিব ও মাদ্রাসাশিক্ষক
চস/স