আমার একটা বদ-অভ্যাস আছে। খুব ভোরে ফোন বেজে উঠলে আমি মোবাইল সাইলেন্ট করে দেই, অতিরিক্ত ফোন আসলে মোবাইলটাই বন্ধ করে দেই। তবে ফোন রিসিভ করি না। এটা একটা মারাত্বক বদ-অভ্যাস আমার।
আজও এমনকটা ফোন আসলো। মোবাইল হাতে নিয়ে সাইলেন্ট করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেলাম। এবার বন্ধ করার জন্য হাতে নিলাম তখন দেখি জেরিন ফোন করেছে। জেরিনের ফোন দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। মোবাইলে তখন সাতটা বাজে। এই সাত-সকালে পাঁচ পাঁচটা কল দিয়ে ফেলেছে জেরিন।
আমি তড়িঘড়ি করে চারপাশে দেখলাম। বাবা-মায়ের রুমে উকি দিলাম। দেখলাম সবাই ঘুম। এরপর আমি দরজা খুলে সিড়ি দিয়ে ছাদে উঠতে উঠতে জেরিনকে কল দিলাম। রিং পড়ার সাথে সাথে রিসিভ করে ফেলে জেরিন। আজও তাই। রিসিভ করতেই আমি বলি, কি সমস্যা? এতো সকাল সকাল ঘুমের ডিস্টার্ব করার কারণ কি। জেরিন কান্না গলায় বললো আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে বাবা। সকাল সকাল এমন বার্তা আমি নই, পৃথিবীর কোনো প্রেমিক পুরুষ আশা করবে না। তবে এমন সিচুয়েশন আসবে এটা আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম। কিš‘ সিচুয়েশনটা এতো ভোরে শুনতে হবে এটা কল্পনায়ও কখনও আসেনি। জেরিন আমার ভালোবাসার মানুষ। যেটাকে এই সমাজ গার্লফ্রেন্ড কিংবা প্রেমিকা বলে জানে। তবে আমার কাছে এই নামটা পছন্দসই না। আমার কাছে জেরিনকে পরিচয় দেওয়ার জন্য ভালোবাসার মানুষ নামটাই বেশ ভালো লাগে।
আমাদের প্রেমের সম্পর্ক একবছরের বেশি হবে। কিš‘ এই একবছরে আমরা দুজন দুজনকে এতো ভালোবেসে ফেলেছি যে মনে হয়, কয়েক বছর আমাদের সম্পর্ক। অনেক সহজ বিষয়েও আমরা খুব সিরিয়াস থাকতাম। একজন অপরজনের এতো কেয়ার করতাম, আমার মনে হতো এমন করে স্বামী স্ত্রীও একে অপরকে করে না। মনে হতো বললে ভুল হবে, আমি আমার বাবা-মায়ের ক্ষেত্রেও এমনটা দেখি না।
যাইহোক জেরিনের কান্না গলায় কথা শুনছি। ফোনের ওপাশ থেকে জেরিন কথার চাইতে বেশি কেঁদে যা”েছ। আমি প্রথমবার ওর কান্নার এভাবে শুনছি। অনেকবার আমার জন্য কেঁদেছে এটা শুনেছি। কিš‘ এই প্রথম তাঁর কান্না নিজ কানে শুনছি। তাঁর কান্নার প্রেমেও যেকোনো ছেলে পড়ে যাবে। আমি এখন নিস্তব্ধ হয়ে তাঁর কান্না শুনছি। সামনে থাকলে তার চোখের জল হাত দিয়ে মুছে দিতাম। আর জড়িয়ে ধরে বলতাম, দূর পাগলি কিছুই হবে না।
যাইহোক জেরিন যা বলছিলো তার সারাংশ হ”েছ, তাঁর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তাকে যেন ক্ষমা করে দিই।
প্রায় আধাঘন্টা ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাঁর এসব কথা শুনতে আমার খুবই বিরক্ত লেগেছে। তবুও শুনা ছাড়া বলার মতো কোনো কথা আমার ছিলো না। তবুও শেষ পর্যন্ত বললাম, তুমি এসব কেন বলছো? তুমি আমার, আমরা-ই থাকবে। আমি আজই আমার বাবা-মাকে বলবো। আমাদের সবকিছু বলবো। এরপর সে চুপ করে থাকে। আমি বললাম রেস্ট নাও। কান্না করো না। আমি পরে ফোন দিব। লাইনটা কেটে দিলাম।
দিনটা এভাবে চিন্তায় চিন্তায় গেলো। কখন যে আমার ভেতরও খারাপ লাগা শুরু হয়েছে বুঝতে পারছি না। বারবার জেরিনের কথা মনে পড়ছে। দুপুরে কিছু খাইনি। রাতেও খাবো না বলে ঠিক করেছি। কিš‘ আমার এক বিরাট সমস্যা। না খেয়েও শান্তি পাই না।
মা এসেছে আমার রুমে। কিরে বাবা কিছু খাবি না? আমি মা’কে বললাম, না আম্মু। আমার কথা বলার সুরটা মা বুঝে ফেলেছে। মা আমার সমস্যা কি জানতে চাইলো। এমন সময় পাশে বড় ভাই বলে উঠল, কোন মেয়ে ছ্যাখা দিছে দেখো। মা বললো, জেরিনের সাথে কিছু হইছে? আমি বললাম, মা ওর বিয়ে। মা তখন একটু অবাক হলো। আবার হেসে বলছে, জীবনে আমার জন্য একফোঁটা চোখের জল ফেলে নাই আমার ছেলে, এখন জেরিনের জন্য ফেলছে। কি ভালোবাসা আমার ছেলের। একথা শুনে আমি খানিকটা লজ্জা পেলাম। তবুও চোখের জল থামছে না। সত্যি জেরিনকে আমি অনেক ভালোবাসি। জেরিনও হয়তো আমাকে ততটা ভালোবাসে। মা খেতে বসে বাবাকে সব বললো। আমাদের পরিবারে বাবা একটু বেশি রাগি। কিš‘ তিনি এই বিষয়টা নিয়ে রিয়েক্ট দেখাননি। মা কান্নার সুরে বাবাকে বলছে, আমার ছেলে আজ সারাদিন কিছু খায়নি। আমার ছেলের জন্য কিছু করবেন না আপনি? বাবা অনেকখানি পর গম্ভীর সুরে বলেন, তোমার ছেলে রাজি থাকলে আমার সমস্যা কি? কিš‘ ওর বড় ভাই তো আছে। আর ওদের কারও এখনও পড়াশোনা শেষ হয়নি। আমি মেয়েটির পরিবারের সাথে কথা বলে সবকিছু ঠিক করে রাখতে পারি। প্রয়োজনে বিয়ের আগ পর্যন্ত যতদিন মেয়ে তাঁর বাবা মায়ের কাছে থাকবে ততদিন খরচ আমি চালাবো। পড়াশোনা শেষ হলে দুই ছেলেকে অনুষ্ঠান করে একসাথে বিয়ে দিব। মা বললো চাকরি ছাড়া বিয়ে? বাবা বললেন, আমি যখন এই সংসারে সাতজনের ভরণপোষণ দিতে পারছি, ওরা আয় করার আগে ওদের দুই বউকেও ইনশাআল্লাহ খাওয়াতে পারবো। এই কথা শুনে আমরা সবাই মুচকি মুচকি হাসছি। মা কিš‘ খুব জোরে হাসছে। আর আমাদের রুমে এসে বলে, দেখেছিস। তোদের বাবা কত ভালো। আর তোরা সারাক্ষণ বাবাকে ভয় পাস।
এসব বলতে বলতে মা আমাকে ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করলো। আমিও সেই অপেক্ষায় ছিলাম। এমন সুন্দর সংবাদ পেয়ে আর না খেয়ে থাকার কষ্ট নিতে পারবো না। আমার বাবা যে আসলেই সুন্দর এবং দারুণ একটা মানুষ সেটা আবারও বুঝলাম। সত্যি বলতে বাবার কাছ থেকে এমন কথা শুনবো এটা কল্পনায়ও আশা করিনি। এটা আমার নয়, পৃথিবীর কোনো বাবা বলতে পারবে এমনটা আমি বিশ্বাস করতে পারিনা। যাইহোক রাতটা পার করে দিলাম। জেরিনের সাথে কথা বলা বন্ধ রাতে। আজ একমাস আমাদের মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। সকলে ঘুম থেকে উঠে ম্যাসেজ দিলাম। জেরিন ম্যাসেজের রিপ্লাই দিয়ে বললো, সে সুযোগ পেলে কল দিবে। এরপর জেরিন দুপুর বারটার দিকে কল দেয়। আমি খুশির ভঙ্গিতে বললাম, জান আর কোনো চিন্তা নাই। আমি বাবা-মায়ের সাথে কথা বলেছি। ওরা সবকিছু তোমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে ঠিক করবে। কিন্তু ওপাশ থেকে জেরিনের উত্তরটা তখন শোনার মতো প্রস্তুত আমি ছিলাম না।
জেরিন আমাকে উত্তর দেয়, দেখো তুমি এখনও চাকরি করো না। তোমার ভবিষ্যত অনেক সুন্দর। আমার জন্য তোমার ভবিষ্যত নষ্ট করিও না। আর আমি আমার বাবা-মাকে কষ্ট দিতে পারবো না। তুমিও তোমার বাবা-মাকে কষ্ট দিও না। জেরিন আমার কথা বুঝার কোনো চেষ্টায় করেনি। তার সহজ সাবলীল কথায় বুঝা যায় সে আমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবে। আরও সহজ বিষয় সে তার পরিবারের ঠিক করা বিয়েটা মেনে নেয়। এসব শুনার পর আমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। মোবাইল বন্ধ করে অনেকটা সময় নিয়ে বেলকনিতে বসে বসে কান্না করছিলাম। কান্না করতে করতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম কখন আমার মা আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের দিকে ফিরতেই মা বললো, পৃথিবীতে মায়ের ভালোবাসা ছাড়া সবকিছুতেই ধোঁকা আছে। কোথাও সঠিক ভালোবাসা পাবি না বাবা। রাতে বাবা যখন আমার বিষয়টা নিয়ে জিজ্ঞেস করছে মা কোনো উত্তর দিতে পারছে না। তখন বাবা হাসছে। বাবা পুরো বিষয়টি কেমন করে যে আন্দাজ করেছে আমি বুঝতে পারিনি। এজন্য আমি আমার বাবাকে মাঝে মাঝে সুপারম্যান বলি। বাবা মাঝে মাঝে আমাদের ভেতরের খবর সব জেনে যায় কি করে এটাই আমি ভাবতে পারি না। এ-ই যেমন বাসায় কোনো ঝগড়াঝাটি, বাসায় কারও অসুখ এসব বাবার কেমন যেন অনুভবের মতো হয়ে যায়। সেদিন বাবা তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসে। যাইহোক বাবা এই বিষয়টাও মোটামুটি না শুনেই আন্দাজ করে নিয়েছে। আর আমাকে এসে বলেন, শুন বাবা জীবনে এরকম অনেক কিছু হয়। জীবন এসবের জন্য থেমে থাকে না। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য নিজেকে এগিয়ে যেতে হয়। পরিবার ছাড়া পৃথিবীতে কেউ এই জগতে আপন নয়। বাবার এসব কথা শুনে পাশে থাকা বড় ভাই হাসছে। অন্য ভাই-বোনরাও হাসছে মুচকি মুচকি। হাসার দুইটা কারণ আছে। একটা প্রেম বিষয়ে কথা, অন্যটা বাবার মতো এমন একজন কঠিন মানুষের মুখে এসব শুনে। শেষ পর্যন্ত আমি নিজের ভাগ্যকে মেনে নিলাম। আর নিজেকে শান্তনা দিলাম নিজের সততা নিয়ে। আমি তো ফেইক ছিলাম না। কিš‘ জেরিনের ভালোবাসা ফেইক এটা মানতেই পারছি না আমি। আমিই আমাকে এটা মানাতে পারছিলাম না। যাইহোক ফেব্রুয়ারির কোনো এক দিনে তাঁর বিয়ে হয়ে যাবে। এর আগেই সে আমাকে একদিন দেখা করতে বলে ফোন দিয়ে। আমি তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি যেদিন সে বিয়ে করবে এটা তার মুখ থেকে শুনেছিলাম। মাঝখানে একমাসের বেশি সময় আর যোগাযোগ রাখিনি। হঠাৎ ফোন করে দেখা করতে বলায় একটু অবাক অবশ্য হলাম। তাই জেরিনকে জিজ্ঞেস করলাম কি কারণে দেখা করতে বলছো?সে আমাকে বলে, আগে আসো। আসলেই বুঝতে পারবে। আমার তার চেহারা দেখার মতো সেই সহ্য ক্ষমতা নেই। তাই দেখা করতে যাইনি। সে ফোন দিয়েছিলো সাড়ে এগারোটায়। কলেজেই দেখা করার কথা ছিলো। দুপুর তিনটার দিকে আমাদের কলেজে যারা পড়ি সেসব ছেলেদের একটা গ্রুপে জেরিনের বিয়ের কার্ড দিয়ে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে সবাই। আমি দেখে একটু বেশি মর্মাহত হলাম। একটু পর মাথায় এসেছে আমাকেও কি বিয়ের কার্ড দেওয়ার জন্য ফোন করেছিলো! এই বিষয়টা জানার জন্য এবার জেরিনকে আমি ফোন দিলাম। রিসিভ করার সাথে সাথে জেরিনকে বললাম, তুমি কি আমাকে কলেজে ডেকেছ বিয়ের কার্ড দিতে? কিছুক্ষণ চুপ থেকে জেরিন বলে, হুম। আমার মাথা আর কন্ট্রোলে ছিলো না। আমি জেরিনকে যা এসছে মুখ দিয়ে তা-ই বলেছি। এর মাঝখানে জেরিন শুধু বললো আমার কথাটা শুনো। আমি তার কথা শুনতে আগ্রহী ছিলাম না। তাই তাকে কিছু বলার সুযোগও দিলাম না। আমি জানি সে কি বলবে। কিš‘ তার চিন্তা ভাবনা দেখে আমি বিস্মিত। আমার কথা বলা শেষে ফোন কেটে দিলাম। এরপর সে আমাকে ফোন দিলে আমি কেটে দিই। পর পর দুবার ফোন আসলে রিসিভ করে সোজা বলে দিই আর কোনোদিন আমার নম্বরে ফোন আসলে সমস্যা হবে। ক্ষতি তোমার হবে না। হবে আমার। আমার যা ক্ষতি করার করছো। আর অল্প যেটা আছে সেটাও করতে চাইলে ফোন দিও। এটা বলে আবারও ফোন কেটে দিলাম। সেদিন আর ফোন আসেনি। এর তিনদিন পর তার বিয়ে হয়। বন্ধুরা তার বিয়েতে গিয়ে ছবি দেয়। ছবি দেখে কখনও হাসি আবার কখনও কান্না করি। সত্যি বলতে কান্নার পরিমাণ বেশি ছিলো। আমি জীবনে অনেক কেঁদেছি। কিš‘ প্রতিবার কান্না শেষ করতে পেরেছিলাম। কিš‘ সেদিন কান্না শেষ করতে পারছি না। নিজেকে প্রশ্ন করলাম কেন কাঁদছি? আমি তো ছেলে! আমার কি সমস্যা? এসব বলে শান্তনা দিয়ে চোখ মুছলেও চোখ দিয়ে অনবরত পানি যে পড়ছে সেটা বন্ধ করতে পারলাম না। সেদিন বুঝলাম চোখ মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কখন থাকে। পরিবারের সবাই আমার কান্না দেখে ফেলেছে। কিš‘ তারাও জানেনা আমাকে কীভাবে শান্তনা দিতে হবে। এভাবে দিন যেতে যেতে একসময় আমিও শান্ত হয়ে উঠেছি। নতুন ভাবে নতুন স্বপ্ন দেখি রোজ।
এরপর কেটে যায় প্রায় ৯/১০ মাস। একদিন হঠাৎ জেরিন আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে বলে, কেমন আছো?
আমি তার ম্যাসেজ দেখে আবারও বিম্মিত! এতোদিন পর সে আবারও কেন আমার সাথে কথা বলতে চাইছে? যাইহোক আমারও রিপ্লাই দেওয়ার ইচ্ছে ছিলো। তাই রিপ্লাই দিয়ে বললাম, ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?
জেরিন রিপ্লাই দিয়ে বলে, ভালো।
আমি নিজ থেকে আবারও বলি, তোমার বাসার সবাই কেমন আছেন?
জেরিন রিপ্লাই দেয়, ভালো। তোমার?
আমিও উত্তর দিই, ভালো।
এররপর সে আমাকে ম্যসেজ দিয়ে বললো, একটা খুশির সংবাদ আছে। সেটা বলার জন্যই তোমাকে ম্যসেজ দিলাম।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, বলো।
জেরিন রিপ্লাই দিলো, আমি অন্তঃসত্ত্বা……….
লেখক : আজহার মাহমুদ