আহমেদাবাদ শহর যেন লোকে লোকারণ্য! আয়োজক ভারত ফাইনালে ওঠায় এমনটা হবারই ছিল। নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম যে জন সমুদ্রে রূপ নেবে এটা অনুমেয়ই ছিল। সকাল থেকে আসা ভারতীয় দর্শকে পুরো গ্যালারিতে ছিল নীলের সমুদ্র। সেখানে হলুদ জার্সি খুঁজে পাওয়াটা একটু দুষ্করই বটে। তবুও কয়েকজন যে ছিল না তা বলার সুযোগ নেই। গ্যালারি এমন একপাক্ষিক হবে সেটা আগে থেকেই জানতেন প্যাট কামিন্স। ম্যাচের আগের দিন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক বলেছিলেন, এমন ভরা গ্যালারিকে চুপ করিয়ে দেয়ার চেয়ে তৃপ্তির কিছু নেই।
ভারতের ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শককেও নীরব বানিয়ে ফেলার লক্ষ্যের কথা জানিয়েছিলেন কামিন্স। টস জিতে একটু পেরেছিলেনও বটে। অস্ট্রেলিয়া যখন টস জিতল তখন পুরো গ্যালারি যেন নীরব হয়ে গিয়েছিল। তবে ভারত ব্যাটিংয়ে নামতেই বদলে গেল চিত্র। রোহিত শর্মার আক্রমণাত্বক ব্যাটিং পুরো গ্যালারিকে আবারও জাগিয়ে তুলে। তবে সেই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি ভারতীয় দর্শকদের। দ্রুত তিন উইকেট হারিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ভারত। বিরাট কোহলি ও লোকেশ রাহুলের হাফ সেঞ্চুরি খানিকটা স্বস্তি দিলেও শেষ পর্যন্ত আক্ষেপে মোড়ানো ব্যাটিংয়ে স্বাগতিকরা থামে মাত্র ২৪০ রানে। লক্ষ্যটা খুব বড় ছিল না অস্ট্রেলিয়ার জন্য।
তবুও শুরু থেকেই আক্রমণ করায় মনোযোগী ছিল তারা। সেটা করতে গিয়ে পঞ্চাশের আগেই তিন উইকেট নেই অজিদের। তখন যেন ২৪০ রানই অনেক মনে হচ্ছিল তাদের জন্য। তবে সেটা মনে হওয়ার আগেই দূরে ঠেলে দিয়েছেন ট্রাভিস হেড। দল চাপে থাকলেও ভারতীয় বোলারদের বিপক্ষে বাঁহাতি এই ওপেনার ছিলেন দুর্দান্ত। হেডকে যথার্থ সঙ্গ দিয়েছেন মার্নাস ল্যাবুশেন। সময় যত বেড়েছে হেডের আক্রমণাত্বক ব্যাটিংয়ের প্রতাপ ততই বেড়েছে। তাতে করে পাত্তা পায়নি স্বাগতিকরা। হেডের সেঞ্চুরি এবং ল্যাবুশেনের হাফ সেঞ্চুরিতে ভারতকে স্তব্ধ করে নিজেদের ষষ্ঠ বিশ্বকাপ শিরোপা জিতল অস্ট্রেলিয়া। কামিন্সের দলের কাছে ৬ উইকেটে হেরে তৃতীয় শিরোপা হাতছাড়া করল ভারত।
ইনিংসের প্রথম বলেই উইকেট পেতে পারত ভারত। জসপ্রিত বুমরাহর অফ স্টাম্পের বাইরের বেরিয়ে যাওয়া ডেলিভারিতে ব্যাট চালিয়েছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। ক্যাচ উঠার পর বল স্লিপে গেলেও ধরার চেষ্টা করেননি বিরাট কোহলি ও শুভমান গিলের কেউ। তাতে প্রথম বলেই চার রানের দেখা পায় অস্ট্রেলিয়া। সেই ওভার থেকে আসে মোট ১৫ রান। প্রথম বলে জীবন পেলেও ওয়ার্নারকে ইনিংস বড় করতে দেননি মোহাম্মদ শামি।
ডানহাতি এই পেসারের অফ স্টাম্পের অনেকটা বাইরের বল খেলতে গিয়ে স্লিপে থাকা কোহলির হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেছেন ৭ রান করা ওয়ার্নার। চার-ছক্কা মেরে ভালো শুরুর আভাস দিলেও ইনিংস বড় করতে পারেননি মিচেল মার্শ। বুমরাহর অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দিয়ে উইকেটের পেছনে থাকা লোকেশ রাহুলের গ্লাভসে ক্যাচ দিয়েছেন তিনে নামা এই ব্যাটার। মার্শের ব্যাট থেকে এসেছে ১৫ রান। চারে নেমে থিতু হতে পারেননি স্টিভ স্মিথ।
বুমরাহর অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে ভেতরে ঢোকা ডেলিভারিতে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলেছিলেন অভিজ্ঞ এই ব্যাটার। বলের লাইন মিস হওয়ায় তা সরাসরি আঘাত হানে স্মিথের প্যাডে। আবেদন করতেই স্মিথকে আউট দেন আম্পায়ার। রিভিউ নেয়ার কথা ভাবলেও শেষ পর্যন্ত ফিরে গেছেন আউট মেনেই। তবে রিভিউ নিলে বেঁচে যেতেন চারে নামা এই ব্যাটার। টিভি রিপ্লেতে দেখা যায় বলের ইম্প্যাক্ট ছিল অফ স্টাম্পের বাইরের।
পঞ্চাশের আগে ৩ উইকেট হারিয়ে বিপাকেই পড়েছিল অস্ট্রেলিয়া। মার্নাস ল্যাবুশেন ও হেডের জুটি খানিকটা স্বস্তি দিয়েছে সফরকারীদের। ল্যাবুশেন ধীরগতিতে রান করলেও হেড ছিলেন নিচের চেনা ছন্দেই। চাপের মুখে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত হাফ সেঞ্চুরিও তুলে নিয়েছেন হেড। কুলদীপ যাদবের বলে সিঙ্গেল নিয়ে ৫৮ বলে পঞ্চাশ ছুঁয়েছেন বাঁহাতি এই ওপেনার। হাফ সেঞ্চুরির পর ভারতের বোলারদের উপর চড়াও হতে থাকেন হেড। দারুণ ব্যাটিংয়ে সেঞ্চুরিও তুলে নিয়েছেন তিনি। ৯৫ বলে তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার ছুঁয়েছেন হেড।
সেঞ্চুরির পর দ্রুত রান তুলতে থাকেন বাঁহাতি এই ব্যাটার। জয় থেকে অস্ট্রেলিয়া যখন মাত্র ২ রান দূরে তখন সাজঘরে ফেরেন হেড। মোহাম্মদ সিরাজের শর্ট লেংথ ডেলিভারিতে পুল করতে গিয়ে সীমানার কাছে শুভমান গিলের হাতে ধরা পড়েন তিনি। ভারতের কাছ থেকে ম্যাচ ছিনিয়ে নেয়া ইনিংস খেলা হেড আউট হয়েছেন ১৩৭ রানে। এর আগে হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন হেডকে সঙ্গ দেয়া ল্যাবুশেন। তিনি অপরাজিত ছিলেন ৫৮ রানে। সিরাজের বলে দুই রান নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয় নিশ্চিত করেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।
এর আগে টস হেরে ব্যাটিং করতে নেমে শুরুটা ভালোই করেছিলেন রোহিত শর্মা। তবে ভারতের অধিনায়ককে সঙ্গ দিতে পারেননি শুভমান গিল। মিচেল স্টার্কের শর্ট অব লেংথ ডেলিভারিতে সামনের পায়ের উপর ভর করে পুল করতে গিয়ে অ্যাডাম জাম্পার হাতে ক্যাচ দিয়েছেন তিনি। গিলের ব্যাট থেকে এসেছে ৪ রান। গিল ফিরলেও রানের চাকা সচল রাখেন কোহলি এবং রোহিত। ইনিংসের অষ্টম ওভারে এসে প্রথমবার আক্রমণে স্পিনার হিসেবে ম্যাক্সওয়েলকে নিয়ে আসেন প্যাট কামিন্স।
প্রথম ওভারে সাফল্য না পেলেও নিজের দ্বিতীয় ওভারে উইকেট এনে দেন ম্যাক্সওয়েল। ডানহাতি এই অফ স্পিনারের পরের ওভারে টানা দুই বলে ছক্কা এবং চার মারেন রোহিত। পরের বলে ডাউন দ্য উইকেটে এসে আবারও উড়িয়ে মারতে গিয়েছিলেন ভারতের অধিনায়ক। তবে ব্যাটে-বলে ঠিকঠাক না হওয়ায় ফিরে যেতে হয় হেডের দুর্দান্ত ক্যাচে। দারুণ ব্যাটিং করা রোহিতের ব্যাট থেকে এসেছে ৩১ বলে ৪৭ রান। চারে নেমে দ্রুতই ফিরে গেছেন শ্রেয়াস আইয়ার।
কামিন্সের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেছেন ৪ রান করে। মাত্র ৫ বলের ব্যবধানে ২ উইকেট হারানোর পর থেমে যায় ভারতের রান তোলার গতি। সাবধানী ব্যাটিংয়ে ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন রাহুল এবং কোহলি। বাউন্ডারি না পেলেও নিয়মিত সিঙ্গেল নিতে থাকেন তারা দুজন। এদিকে ৫৬ বলে হাফ সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন। এদিকে ৯৭ বল পর বাউন্ডারির দেখা পেয়েছে ভারত।
হাফ সেঞ্চুরির পর বেশিক্ষণ টিকতে পারেন কোহলি। ৬৩ বলে ৫৪ রান করা কোহলিকে থামিয়েছেন কামিন্স। তাকে বোল্ড করেন অজি অধিনায়ক। এরপর রাহুলকে সঙ্গ দিতে আসেন রবীন্দ্র জাদেজা। তবে এই জুটিকে থিতু হতে দেননি জশ হ্যাজেলউড। ৯ রান করা জাদেজাকে তিনি উইকেটের পেছনে জশ ইংলিসের ক্যাচ বানিয়েছেন।
রাহুল হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেয়ার পর ৬৬ রান করে ফিরেছেন। তাকে আউট করে স্টার্ক। এই অজি পেসারের গুড লেন্থের বলে রিভার্স শট খেলতে গিয়ে আউট সাইড এজ হয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন। এরপর মোহাম্মদ শামিকেও আউট করেছেন স্টার্ক। খানিক বাদে অ্যাডাম জাম্পার শিকার হয়ে জসপ্রিত বুমরাহ এলবিডব্লিউ হলে ভারতের ইনিংস আর বেশিদূর এগোতে পারেনি। ভারতের শেষ ভরসা সূর্যকুমার যাদব আউট হন মাত্র ১৮ রান করে। ফলে আড়াইশ রানের কোটা পার হতে পারেনি ভারত।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ভারত- ২৪০/১০ (৫০ ওভার) (রোহিত ৪৭, গিল ৪, কোহলি ৫৪, রাহুল ৬৬; স্টার্ক ৩/৫৫)
অস্ট্রেলিয়া- ২৪১/৬ (৪৩ ওভার) (ওয়ার্নার ৭, মার্শ ১৫, হেড ১৩৭, ল্যাবুশেন ৫৮*; বুমরাহ ২/৪৩)
চস/আজহার