ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নিয়ে অনেকের অনেক মতামত থাকতে পারে। তবে আমার কাছে বিষয়টা একটু অন্যরকম। ছাত্র রাজনীতি থাকবে তবে সেটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নয়। প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করলেই কমে আসতে পারে এ অরাজকতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি কারো কোনা আলাদা ক্ষমতা না থাকে তাহলে বন্ধ হবে মৃত্যুর এই লীলা খেলা।
আপনি বলতে পারেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি না থাকলে ছাত্রদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্দোলন করবে কারা? এবং এসব বিষয় নিয়ে কথা বলবে কারা? তবে যারা এমন প্রশ্ন করেন তাদের কাছে আমারও প্রশ্ন বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজনীতর মাধ্যমে পরিবর্তন এবং উন্নত হয়েছে? কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজনীতির মাধ্যমে তার প্রতিষ্ঠানকে অন্যসকল প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদাভাবে গড়ে তুলেছে? এমনটা কেউ দেখাতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।
এমনিতেও ছাত্ররাজনীতির কাজ কি সেটাও আমি বুঝে উঠতে পারছি না। অনেকে বলেন, ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে বড় বড় নেতা তৈরী হয়ে উঠে। কিন্তু আমি মনে করি বাংলাদেশে নেতা হতে গেলে ছাত্ররাজনীতি করে উঠতে হয় না এখন। আপনি কি এদেশে আর একটা বঙ্গবন্ধু আবিষ্কার করতে পারবেন? কখনওই না। কারণ তিনি ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন।
তার আদর্শ, চরিত্র, নেতৃত্ব কোন ছাত্রের ভেতর আছে বর্তমানে? আমি হলফ করে বলতে পারি বঙ্গবন্ধুর কিঞ্চিৎ পরিমান আদর্শ এখনকার ছাত্রনেতাদের ভেতর নেই। তাহলে কিসের ছাত্র রাজনীতি। দরকার নেই এ ছাত্ররাজনীতির। এর চাইতে আনিসুল হক, নওফেল, মাশরাফীরা হাজার হাজারগুণ ভালো নেতা। এরা তেমন ছাত্ররাজনীতি করেন নাই। তবে যেখানেই ছিলেন, যেভাবেই বেড়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেছিলেন। তাদের ভেতর ছিলো সৎ সাহস আর সৎ নেতৃত্বের মনোভাব। যা এখনকার ছাত্র সমাজের ভেতর খুব কম।
এরপরও আমি বলবো না ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হোক। তবে এ ছাত্ররাজনীতি হোক ওয়ার্ড় এবং মহল্লা ভিত্তিক। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি থাকুক এটা আমি চাই না। আমি না শুধু, বাংরাদেশের অনেকেই এমনটা আশা করেন না। ১২ অক্টোবর ২০১৯ প্রথম আলোতে কবি সোহরাব হাসান লিখেছেন, স্বাধীনতার পর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫১ জন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৪ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ২ জন করে, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং হজরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন করে শিক্ষার্থী খুন হন। আগের কথা যদি বাদও দিই, আওয়ামী লীগের টানা গত ১০ বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ জন শিক্ষার্থী খুন হন, যার মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনটির নেতা-কর্মীই বেশি। কিন্তু একটিরও বিচার হয়নি। বিচার হলেও কেউ শাস্তি পাননি। আসামিদের কেউ কেউ পলাতক অথবা বিদেশে পালিয়ে গেছেন।
২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন আবুবকর নামের এক শিক্ষার্থী। কিন্তু মামলার রায়ে ২০১৭ সালের ৭ মে ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতা–কর্মীর প্রত্যেককে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের নির্যাতনে অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ নিহত হন। তিনিও ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মী ছিলেন। ছয় বছর পর হাইকোর্ট অভিযুক্ত পাঁচ ছাত্রলীগের কর্মীকে মৃত্যুদন্ড দিলেও সেই রায় কার্যকর হয়নি। ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হয় রাজু। তার হত্যার বিচারও হয়নি।
এছাড়াও গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টি খুনের ঘটনা ঘটে। এরপরও যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আরও ছাত্র হত্যা করতে চান তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি চালু থাকুক। বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে আবরার হত্যার পর। এভাবে একেকটা প্রতিষ্ঠানে একেকটা আবরার হত্যা হওয়ার পরে এসব প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ হবে। যদি আর কোনো আবরারকে হারাতে না চান তা হলে এখনই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
গত মাসেই চট্টগ্রামের এমইএস কলেজে খুন হয়েছে সানি নামক এক কিশোর। ছেলেটাও ছাত্ররাজনীতির বলি। ছাত্ররাজনীতি মানে এখন মারামারি আর খুন করা। ছাত্ররাজনীতি মানে হাতে বই-খাতার বদলে লাটি, চুরি আর চাপাতি। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোন ধরনের রাজনীতি চলে সেটা বুয়েটের কিছু শিক্ষার্থী বলেছেন। যা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। তবে এর চাইতেও ভয়ংকর এবং নোংরা রাজনীতি চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অনেক অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী থাকুক না থাকুক দু পাশে রাজনীতির দু-গ্রুপ বসে থাকবে।
ক্যাম্পাসের ভেতর চলে রাজনীতির মিছিল মিটিং স্লোগান। ক্লাসে বিঘœ ঘটলেও এসব নিয়ে কেউ বলতে পারে না জীবনের মায়ায়। এসব রাজনীতিতে শিক্ষকরাও অনেক সময় যুক্ত থাকেন। যারা যুক্ত থাকেন না তারাও ভয়ে কিছু বলেন না। এমন পরিবেশের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কীভাবে জ্ঞানী হয়ে উঠবে সেটাও চিন্তার বিষয়। ছাত্ররাজনীতি হোক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবাই এক। ছাত্রদের স্বার্থে সকলে একসাথেই তখন রাস্তায় নামবো। কোনো বিভক্ত হতে হবে না তখন। তাই বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা সময়ের দাবী।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক
ইমেইল : azharmahmud705@gmail.com