spot_img

৪ঠা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, সোমবার
১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সর্বশেষ

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

টাইগারপাসে শতবর্ষী গাছ কাটবে সিডিএ

চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও হয়েছে। তবে শেষ হয়নি বিভিন্ন স্থানে র‌্যাম্প নির্মাণ। এরই মধ্যে একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়েছে নকশা। এবার টাইগারপাস সড়কে র‍্যাম্প নির্মাণ করতে চায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এজন্য ৪৬ গাছ ও পাহাড়ের ঢালু অংশ কাটতে চায় সংস্থাটি। এতে গাছ ও পাহাড় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের বন্দর এলাকার সঙ্গে রেলওয়ের সিআরবি ও পলোগ্রাউন্ড মাঠের সংযোগ স্থাপনে পাহাড়ের ঢালে টাইগারপাস সড়ক নির্মাণ করা হয়। সিআরবি পাহাড়ের পাদদেশের ওপরের অংশে টাইগারপাস থেকে যাতায়াত এবং নিচের অংশে নিউমার্কেট থেকে টাইগারপাসমুখী সড়ক নির্মাণ করা হয়। এটি স্থানীয়দের কাছে দ্বিতল সড়ক হিসেবে পরিচিত। পাহাড় অক্ষুণ্ন রেখে চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন এ সড়কের নামকরণ করা হয় ইউসুফ চৌধুরীর নামে। এ সড়কের বিভাজক হিসেবে রাখা হয়েছে পাহাড়ের ঢাল। সড়ক বিভাজকে রিটার্নিং ওয়াল ছাড়াও লাগানো হয়েছে কয়েকশ ছোট-বড় গাছ। বেশকিছু গাছের বয়স ১০০ বছর পেরিয়ে গেছে। এসব গাছে নানা রকম পাখির বাসাও রয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ১৫টি র‌্যাম্প নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সিডিএ। এজন্য রেলওয়ের কাছ থেকে আগাম অনুমতি নেয়া হয়নি। র‍্যাম্প নির্মাণেজর জন্য ঠিকাদার নিয়োগ ও সয়েল টেস্ট করা হয়েছে। এখন ৪৬টি গাছ কাটতে রেলওয়ের কাছে অনুমতি চাওয়া হচ্ছে। প্রায় এক মাস আগে বন বিভাগের কাছে গাছ কাটার অনুমতি চেয়েছে সিডিএ। টাইগারপাস থেকে একটি র‌্যাম্প সড়কটিতে তৈরি করলে নিউমার্কেটের সঙ্গে শেখ মুজিব রোডের সংযোগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে আশঙ্কা করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস গত ২৫ মার্চ বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপককে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে আগ্রাবাদ ও টাইগারপাস এলাকায় দুটি র‌্যাম্প নির্মাণে ৩৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ ভূমি ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া হয়। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা থেকে বিমানবন্দরমুখী আপওয়ার্ড র‌্যাম্প নির্মাণে ২১ দশমিক ৭৭ শতাংশ ও রেলওয়ের পলোগ্রাউন্ড বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় সড়ক থেকে দেওয়ানহাটমুখী আপওয়ার্ড র‌্যাম্প নির্মাণে ১৪ শতাংশ ভূমি ব্যবহারের কথা বলা হয়।

সিডিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে’ উদ্বোধন করেন। আনুষঙ্গিক কাজ অসমাপ্ত থাকায় উদ্বোধনের পরও লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েতে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রথম নকশা পরিবর্তন করে এক্সপ্রেসওয়েটির একাধিক র‌্যাম্প নির্মাণের কাজ সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অনুমোদন করেছে। পরে ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে।

সিডিএ সূত্রে জানা গেছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি র‍্যাম্প জিইসি মোড়ের হোটেল দ্য পেনিনসুলার সামনে, দুটি টাইগারপাসে, চারটি আগ্রাবাদে, বন্দরসংলগ্ন ফকিরহাট এলাকায় একটি, নিমতলায় দুটি, চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকায় দুটি, কর্ণফুলী ইপিজেড-সংলগ্ন দুটি ও সিমেন্ট ক্রসিং এলাকায় একটি র‍্যাম্প থাকবে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের জুনে। এর মধ্যে পাঁচটি র‌্যাম্পের কাজ শুরু হওয়ায় বর্ধিত সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

সিডিএর তথ্যমতে, বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মালিকানাধীন গোসাইলডাঙ্গা মৌজায় ৯ হাজার ৪৮৫ বর্গফুট (২১ দশমিক ৭৭ শতাংশ) জমি ব্যবহার হবে। পলোগ্রাউন্ড বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়সংলগ্ন রোড থেকে দেওয়ানহাটমুখী আপওয়ার্ড র‌্যাম্প নির্মাণে ৬ হাজার ১০০ বর্গফুট (১৪ শতাংশ) পাহাড়ি জমি ব্যবহার করবে সিডিএ। আগ্রাবাদের জমিতে বরাদ্দ দেয়া ৫৯টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও পলোগ্রাউন্ড রোডসংলগ্ন এলাকার জমিতে কোনো স্থাপনা নেই বলে দাবি করেছে সিডিএ।

সম্প্রতি সরজমিনে দেখা গেছে, সিডিএ পলোগ্রাউন্ড এলাকায় র‌্যাম্প নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থানে রয়েছে অর্ধশতাধিক ছোট-বড় গাছ। সিডিএর নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাওয়ার আগেই মাটি পরীক্ষা করে ওই এলাকার গাছ কাটার প্রস্তুতি নিয়েছে। এরই মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ৪৬টি গাছ নির্দিষ্ট করে (ক্রস এঁকে) রেখেছেন।

যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা (শহর) মো. আবদুল মালেক বলেন, ‘‌প্রায় এক মাস আগে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ৪০টির বেশি গাছ কাটতে অনুমতি চায়। আমরা সরজমিনে খতিয়ান পর্যালোচনা করেছি। গাছগুলো রেলওয়ের সম্পত্তি। এখতিয়ারভুক্ত না হওয়ায় গাছগুলো রক্ষা কিংবা কাটতে বাধা দিতে পারছে না বন বিভাগ।’

বেসরকারি সংগঠন ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান অপিনিয়ন (ইকো) ২০২১ সালে সিআরবি এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে জরিপ করে। জরিপে ২২৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বড় বৃক্ষ ৮৮ প্রজাতির, গুল্ম ৪১ প্রজাতির, বীরুৎ ৭২ প্রজাতি ও লতাজাতীয় উদ্ভিদ রয়েছে ২২ প্রজাতির। ঔষধি উদ্ভিদ পাওয়া গেছে ১৮৩ প্রজাতির। গবেষণাধীন ২০টি এলাকার মধ্যে এ এলাকায় সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নয়টি বিপন্ন প্রজাতি রেকর্ড করা হয়েছে। সিআরবি পাহাড়ে দ্বিতল এ সড়ক বিভাজকে শিরীষ, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, পেয়ারা, ইউক্যালিপটাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। পাহাড়ি এ সড়কের ওপরের অংশের ধস প্রতিরোধে এ গাছগুলো সুরক্ষা দেয়াল হিসেবে কাজ করে। এর আগে সিআরবি এলাকায় পিপিপি পদ্ধতিতে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিলে স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবিদরা আন্দোলন করেন।

জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, ‘‌সড়কটির যে অংশে র‌্যাম্প নির্মাণ হবে, সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। এ কারণে এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা বন বিভাগের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। যদি দুটি সংস্থা অনুমতি দেয়, তবেই র‌্যাম্প নির্মাণের সুযোগ পাবে সিডিএ। আমরা বিষয়টি বন বিভাগকে জানিয়েছি।’

যদিও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, পলোগ্রাউন্ড অংশে পাহাড়ি সড়ক বিভাজকে র‌্যাম্প স্থাপন না করে বিকল্প পথ ব্যবহারের কথা জানানো হয়েছে সিডিএকে। কিন্তু টাইগারপাস এলাকায় র‌্যাম্প নির্মাণের বিকল্প কোনো পথ না থাকায় পাহাড়ি এ দ্বিতল সড়ক বেছে নেয়া হয়েছে। এর আগেও সিডিএর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সড়ক, ফ্লাইওভার নির্মাণে গাছ ও পাহাড় কাটার অভিযোগ উঠেছে।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস মনে করছেন, পরিবেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সিআরবি এলাকায় র‌্যাম্প নির্মাণ করা হবে। ফলে পাহাড়ি এ সড়কে র‌্যাম্প নির্মাণে গাছ কাটা হলেও পরিবেশের ক্ষতি হবে না।

তিনি বলেন, ‘‌র‌্যাম্প নির্মাণে ৪৬টি গাছ কাটার পরিকল্পনা থাকলেও আমরা কয়েক গুণ গাছ রোপণ করব। পাহাড়ের ঢালে দ্বিতল পদ্ধতিতে নির্মিত সড়কটির কোনো ক্ষতি না করে জাতীয় স্বার্থে র‌্যাম্পটি নির্মাণ করা হবে। এজন্য রেলওয়ের কাছ থেকে জমি নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করবে সিডিএ।’ রেলের বিদ্যমান প্রটেকশন ওয়াল না ভেঙে পাহাড়কে সুরক্ষিত রেখেই সিডিএ র‌্যাম্প নির্মাণের কাজ করবে বলে জানিয়েছেন তিনি। সূত্র: বণিকবার্তা

চস/স

 

Latest Posts

spot_imgspot_img

Don't Miss