জাহাজের সংখ্যা কমিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজজট কমাতে চায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ১২৬টি জাহাজ চলাচলের জন্য অনুমোদন থাকলেও তা ১০০-এর মধ্যে নিয়ে আসতে চায়। তবে প্রাথমিকভাবে ১৫টি জাহাজ কম আনার জন্য শিপিং কোম্পানিগুলোর কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এ জাহাজ কমিয়ে আনা হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের সুনাম কমবে এবং কনটেইনারের ভাড়াও বেড়ে যাবে বলে শিপিং কোম্পানিগুলোর অভিমত।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি কনজারভেটর ক্যাপ্টেন মো. জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত (গত মঙ্গলবার) একটি চিঠি বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান বরাবর দেওয়া হয়। সেই চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলের অনুমোদনপ্রাপ্ত মোট জাহাজ হতে ন্যূনতম ১৫টি জাহাজ কমিয়ে সেসব জাহাজের তালিকা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে পাঠানোর জন্য। গত ২০ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্তের আলোকে ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে তালিকা প্রেরণের কথা ছিল। কিন্তু তা না দেওয়ায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তালিকা দিতে বলা হয়েছে।
জাহাজ কমানোর তালিকা জমা দেওয়া প্রসঙ্গে শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিশ্বের কোনো বন্দরে জাহাজ কমিয়ে আনা হয় না। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রয়োজনেই জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিগত সময়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি ও পরবর্তীকালে ধর্মঘট, প্রাইম মুভার অ্যাসোসিয়েশনের ধর্মঘট ও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পণ্যগুলো আসতে না পারায় এখন বেশি আসছে। আর এজন্য জাহাজের সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। এক মাস জাহাজ চলাচল ও পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক থাকলে আর জট থাকবে না। আমরা তাই বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে এক মাস সময় চেয়েছি।’
কিন্তু জাহাজের সংখ্যা কমাতে হবে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে আসা-যাওয়ার জন্য অনুমোদিত জাহাজের সংখ্যা ৯৬টি। এই ৯৬টি জাহাজ আসা-যাওয়া করে। কিন্তু পণ্যের আধিক্য কিংবা শিপিং লাইনের প্রয়োজনে বা কোনো জাহাজ খারাপ হয়ে গেলে সেই জাহাজের বদলে অ্যাডহক ভিত্তিতে কিছু জাহাজের অনুমোদন দেওয়া হয়। বর্তমানে অ্যাডহকসহ চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলকারী জাহাজ হলো ১২৬টি। এ জাহাজগুলো কমিয়ে আনলেই বন্দরে জাহাজ জটের সংখ্যা কমে আসবে বলে বন্দর কর্মকর্তাদের অভিমত। গত ২০ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সুনাম অক্ষুন্নের স্বার্থে জাহাজের সংখ্যা ৯৬ থেকে ১০০ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা প্রয়োজন।
কিন্তু জাহাজ কমিয়ে আনার এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন শিপিং এজেন্ট কোম্পানিগুলো। এ বিষয়ে কসকো শিপিং লাইনের মহাব্যবস্থাপক রাশেদ আলী বলেন, ‘আমাদের জাহাজ বহির্নোঙরে বসে থাকলেও আমরা বন্দরের কাছে অভিযোগ করিনি। ব্যবসায়ীদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পণ্য নিয়ে আসছি। আর অ্যাডহক ভিত্তিতে যে জাহাজগুলো চলাচল করছে, সেগুলো যখন চলাচল করে তখন তো আগের অনুমোদিত জাহাজগুলো চলাচল করছে না। সে হিসেবে বন্দরে চলাচলকারী জাহাজের সংখ্যা একই থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ ছাড়া অ্যাডহক ভিত্তিতে কিছু জাহাজের অনুমোদন রয়েছে, যেগুলো মাসে একবার একটি রুটে চলাচল করে। সেই জাহাজের কারণে তো আর বন্দরে জট হচ্ছে না।’
তবে অ্যাডহক ভিত্তিতে জাহাজের সংখ্যা কমিয়ে দিলে জাহাজের ভাড়া অনেক বেড়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন শিপিং কোম্পানিগুলো। এর কারণ হিসেবে তারা জানান, এখন যেখানে ১২৬টি জাহাজ পণ্য আনা-নেওয়া করছে। তখন ১৫টি জাহাজ কমিয়ে আনা হলে সেই জাহাজগুলোর পণ্য পরিবহনে চাহিদা বেড়ে যাবে এবং তখন শিপিং কোম্পানিগুলো দাম বাড়িয়ে দেবে।
এদিকে জাহাজ কমিয়ে আনা হলে পণ্য হ্যান্ডলিং কি কমে আসবে? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ফজলে ইকরাম চৌধুরী বলেন, প্রকৃতপক্ষে জাহাজের সংখ্যা কমিয়ে আনা হলে তেমন প্রভাব পড়বে না। বর্তমানে অনেক ছোট আকারের গিয়ারড জাহাজ (ক্রেনযুক্ত জাহাজ) চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়ছে। এসব ছোট জাহাজের পরিবর্তে যদি তিন ক্রেনের বড় গিয়ারড জাহাজ আনা হয়, তাহলে জাহাজের সংখ্যা কমে আসবে। তখন বড় জাহাজগুলো বেশি পণ্য নিয়ে আসবে। একই সঙ্গে এসব জাহাজ গ্যান্ট্রিক্রেন যুক্ত সিসিটি ও এনসিটি টার্মিনাল এবং গ্যান্ট্রিক্রেনবিহীন জিসিবি টার্মিনালে ভিড়তে পারবে। তখন আর বহির্নোঙরে জাহাজ জট হবে না।
জাহাজ কমিয়ে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ও সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘বর্তমানে অনেক জাহাজ অ্যাডহক ভিত্তিতে চলাচল করছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আমরা শুধু শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কাছে তালিকা চেয়েছি। তালিকা প্রাপ্তির পর বন্দর ব্যবহারকারী সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিবের বক্তব্যের সঠিকতা পাওয়া যায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজজট কমানোর জন্য চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরে একটি কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটি জাহাজজট বিষয়ে অধিকতর যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবে। সেই কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি কনজারভেটরকে। কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী ট্রাফিক ম্যানেজার (জোন-এ)। এ ছাড়া কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ডেপুটি ট্রাফিক ম্যানেজার (অপারেশন), টার্মিনাল ম্যানেজার, সহকারী হারবার মাস্টার ও শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি। কমিটির কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে আহ্বায়ক ও বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি কনজারভেটর ক্যাপ্টেন মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে পরবর্তীকালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দরে ৩০টি শিপিং কোম্পানির জাহাজ চলাচল করে। এসব জাহাজ ঘুরেফিরে বন্দরে আসা-যাওয়া করে। গত মাসে বন্দরে ১১৩টি, মে মাসে ১২৬টি, এপ্রিলে ১২২টি, মার্চে ১১৫টি কনটেইনার জাহাজ ভিড়েছে। এসব জাহাজ দিয়েই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দেশের আমদানি-রপ্তানির ৯২ শতাংশ হ্যান্ডলিং করে। এই বন্দর দিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩২ লাখ ৯৬ হাজার কনটেইনার এবং ১৩ কোটি টন কার্গো পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে।
সূত্র: দেশ রূপান্তর
চস/স