মানব জাতি জীবন উপভোগের কথা, সুখে-স্বাচ্ছ্যন্দে জীবন বাঁচার কথা কিন্তু তা না হয়ে ভাবতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত আতঙ্ক ও মৃত্যুর ভয় নিয়ে। জন্মের পর থেকে একটি শিশু তার স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকবে তা সবার উদ্বেগের বিষয়। করোনা দুর্যোগের সাথে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে সমান হারে। মহামারি করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব। ফলে মানুষের জীবনযাত্রা ধমকে আছে। এর মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় জনমনে উৎকণ্ঠা বেড়েই চলছে। বাংলাদেশে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম। মশাবাহিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনকেফালাইটিস ইত্যাদি। তবে বর্তমানে মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে ডেঙ্গু। করোনার জন্য হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহারের পাশাপাশি মাস্ক পরেও এমনিতে একটু শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে।
করোনার ভ্যাকসিন রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরের ভ্যাকসিন নেই। কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসাও নেই। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মশাবাহিত অন্য রোগ নিরাময়ে সক্ষম হলেও প্রাণঘাতী ডেঙ্গু নিরাময়ে অক্ষম। কোন শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তার যন্ত্রণা দেখে পিতা-মাতা কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ তা উপলব্ধি করতে পারবে না। তাই ডেঙ্গুতে ভয় খুব বেশিই হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। সে বছর আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়ালেও ২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটা কম ছিল। গত বছর ১ হাজার ৪শ ৫ জন রোগী হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছে বলে জানা গেছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৩ হাজার ৮৭৫ জনে। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১২ হাজার ৫৬১ জন এবং মারা গেছেন ৫৪ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়, মশাবাহিত রোগে প্রতিদিন বিশ্বে তিন হাজার লোক মারা যায়। বছরে মারা যায় দশ লাখ লোকের বেশী। রিপোর্ট অনুযায়ী মশাবাহিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু সবচেয়ে বেশী ভয়ঙ্কর। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় রয়েছে ১৪ প্রজাতির মশা। ডেঙ্গু মশার জীবাণু দ্বারা প্রচন্ড জ্বর, তীব্র মাথা ব্যথা, কাঁপুনি, পেশী সংকোচন ও বমি ইত্যাদি হয়ে থাকে। অ্যানোফেলিস থেকে ম্যালেরিয়া এবং এডিস মশার দংশনে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে।
ট্রপিক্যাল-সাবট্রপিক্যাল অঞ্চলে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব বেশি। ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ চীন, তাইওয়ান, প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জ, কিউবা ও কেইম্যান দ্বীপ বাদে ক্যারিবিয়ান দেশগুলো, আফ্রিকা, চিলি, প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা বাদে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা হলো এই রোগের প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল।
আমরা যদি একটি “মশার নগরের” কথা বলি তাহলে দেখা যাবে, মশার নগরে মানুষের জন্মের পর থেকে প্রধান কাজ যেন মশার কামড়ে রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করা কারণ প্রতি মিনিটে ম্যালেরিয়া মারা যায় দুজন শিশু। টাকার বিনিময়ে মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘরের বাইরে মশারির নীচে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তার পরও মশার হাত থেকে রেহাই নেই। কারণ মানুষ যখন ঘুমাতে যায় তার ঠিক আগে এবং ভোরে যখন ঘুম থেকে ওঠে, তখন রক্তক্ষুধা মেটানোয় জন্য রক্ত খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷ অবস্থা সামাল দিতে ‘মসকিটো ল্যান্ডিং বক্স’ তৈরী করল মানুষ৷ কাঠের তৈরি কালো রঙের এ এমন এক বাক্স, যা আসলে মশা মারার নতুন ধরনের ফাঁদ৷ বাক্সে যাতে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা এসে বসে, সে ব্যবস্থা করতে অভিনব উপায়ে বাতাসে ছড়নো হয় মানুষে ঘামের গন্ধ৷ সেই গন্ধ পেলেই মশারা ভাবে বুঝি যন্ত্রটির ভেতরেই রয়েছে তাদের ‘সুস্বাদু’ খাবার৷ খাবারের লোভে উড়ে এসে জীবনটুকু শেষ হয়। এটি কোনো রূপ কথার গল্প নয় এই ঘটনা টি ঘটেছিল তাঞ্জানিয়ার ইফাকারা নামক এক শহরে। ফলে আমাদের করোনা ভাইরাসের চেয়ে আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু মশা। তাহলে প্রশ্ন জন্ম দিচ্ছে, আমাদের দেশের শহর গুলো কি মশার শহর তৈরী হবে? স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছে বাংলাদেশ। এ পাঁচ দশকে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় বসেছে। মশক নিধন ও নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু মশার দাপট কি থামাতে পারছে? দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা প্রচার কিংবা ফটোসেশনে যতটা উৎসাহী, আসল কাজে তেমনটা দেখা যায় কি? যদি তা-ই হতো তাহলে পরিস্থিতি এতটা অশনিসংকেতের দিকে যেত না। মশার কামড়ে রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা কবে শেষ হবে? রংপুরের গ্রাম অঞ্চলের মানুষ মশা তাড়ানোর জন্য এক বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করত তা হল, সন্ধ্যায় ধুনাতে আগুন দিয়ে সারা বাড়ি ধোঁয়ায় ভরে দিত আর বলত “মশারে মশা তেলের তাড়ি যা মশা তোর মাসির বাড়ি” এভাবেই মশাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু এখন ডিজিটালাইজেশনের যুগে গ্রামের প্রাচীন পদ্ধতিতে বসে থাকতে তো পারি না। তার জন্য বিজ্ঞান ভিত্তিকভাবে মশা নিধনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
১৯৩০ সাল থেকে প্রতিবছর ২০ আগস্ট দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ব্রিটিশ চিকিৎসক রোনাল্ড রস ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট ম্যালেরিয়া রোগের কারণ ‘অ্যানিফিলিস প্রজাতির মশা’ আবিস্কার করায় এ দিনটি ‘বিশ্ব মশা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। মশা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘ম্যালেরিয়াশূন্য লক্ষ্য অর্জন’ উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ও মানুষের অসচেতনতার মধ্য দিয়ে কিভাবে লক্ষ্য অর্জন করবে।
ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার দুটি প্রজাতির মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়ায়। সেগুলো হলো, এডিস ইজিপ্টি ও অ্যালবোপিকটাস প্রজাতি। এডিস ইজিপ্টিকে শহুরে ও অ্যালবোপিকটাসকে গ্রামের মশা বলা হয়। এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে জন্ম নেয়। বর্ষাকালে এর ঘনত্ব বেশি হয়। তাই ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব এ সময়ে বেড়ে যায়।
মশা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মশার প্রজাতি ও আচরণভেদে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা আলাদা হতে হবে। মশার প্রজননস্থল খুঁজে বের করতে হবে। সেই স্থান গুলো ধ্বংস করে দিতে হবে। জীবজ নিয়ন্ত্রণ, অর্থাৎ উপকারী প্রাণির মাধ্যমে মশাকে নিয়ন্ত্রণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। মশা নিয়ন্ত্রণে লার্ভিসাইড এবং অ্যাডাল্টিসাইড কীটনাশক ব্যবহার করা।
ডেঙ্গু বিস্তারের জন্য মানবজাতি দায়ী কারণ আমরা সকালে ঘুম থেকে রাতে ঘুমার আগ পর্যন্ত যেসব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যবহার করে থাকি সেগুলোতে পানি জমে আমাদের চিরশত্রু এডিস মশার বংশবিস্তার করে থাকে। বিকালের আড্ডা ও সন্ধ্যায় গল্পের সঙ্গে থাকে চা। ফলে এই প্লাস্টিকের চায়ের কাপ শরীরের যেমন ক্ষতিকর ঠিক তেমনি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আর সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে যত্রতত্র ফেলা কাপে পানি জমে এডিস মশার বংশবিস্তার হচ্ছে।
ফলে আবর্জনার মধ্যে চিপস ও বিস্কুটের খালি প্যাকেট, ডাবের খোসা, কাগজের প্যাকেট, ছেঁড়া বস্তা, পুরোনো তোশক-বালিশ, ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেট, চা বা কফির কাপ, সিগারেটের বাক্স, ডিমের খোসা ইত্যাদি। এছাড়াও আমাদের বাড়ির আশেপাশে বারান্দা বা ছাদে পরিত্যক্ত মাটির পাত্র, বালতি, ড্রাম, ফুলের টব, ডাবের খোসা, প্লাস্টিক ও কাচের খালি বোতল, গৃহস্থালির ভাঙা ও পরিত্যক্ত অন্যান্য জিনিসপত্র, টায়ার, নির্মাণাধীন ভবনে বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার লার্ভা জন্ম নেয়। তাই পরিবেশে রক্ষা ও জীবন বাঁচার জন্য নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে হবে পাশাপাশি রাষ্ট্রকে তাঁর ভূমিকা যথাযথ ভাবে পালন করতে হবে। রাস্তার পাশে যত্রতত্র ডাস্টবিন স্থাপন না করে পরিকল্পিতভাবে ডাস্টবিন স্থাপন করতে হবে।
সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডকে সুনির্দিষ্ট ভাবে ব্লকে ভাগ করে কার্যক্রম চালাতে হবে। প্রতিটি ব্লকের জন্য একজন এন্টোমলজি টেকনিশিয়ান, দুজন করে স্প্রেম্যান, একজন করে ক্লিনার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন ওয়ার্ড সুপারভাইজার থাকবেন। এ কাজগুলো বাস্তবায়নের জন্য অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ দিয়ে আধুনিক এবং সময়োপযোগী গাইডলাইন তৈরি করে নিতে হবে।
ডেঙ্গু রোগ থেকে বাঁচতে সবাইকে নিজ বাসস্থান ও চারপাশে স্বচ্ছ পানি যাতে জমে না থাকতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। ঘরের ভেতর ও বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। এই মহাবিপদে আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু হলো মশারি। তাই অসহায়, কর্মহীন, হতদরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের মাঝে সরকারি উদ্যোগে বিনামূল্যে মশারি বিতরণের পদক্ষেপ নিতে হবে। বাসাবাড়িতে সবাইকে মশারি ব্যবহার করতে হবে। নিয়মিত মশানাশক স্প্রে করতে হবে। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর কারো জ্বর হলে সেটাকে সাধারণ জ্বর মনে করে অবহেলা না করে টেস্ট করতে হবে। কারো জ্বর, গাব্যথা, বমি এবং হাতে-পায়ে ফুসকুড়ি কিংবা র্যাশ হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।
মশাকে সঠিকভাবে নিধন ও নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রয়োজন সমন্বিত ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ জনগণের সম্পৃক্ততার গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। তা না হলে মশার রাজ্যে বসবাস করতে হবে। ডেঙ্গুতে মানুষের মৃত্যু শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আনতেই রাষ্ট্রের অবস্থান থেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।
রাশেদ ইসলাম
শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ,জয়পুরহাট সরকারি কলেজ।
Email :rashedssf12@gmail.com