spot_img

৭ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, সোমবার
২২শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ডেস্ক রিপোর্ট

সর্বশেষ

চট্টগ্রামে শহরের বাসিন্দারাই ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ায় বেশি আক্রান্ত

চট্টগ্রামে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এখন আর কয়েক দিনের জ্বর বা মৌসুমি আতঙ্কে সীমাবদ্ধ নেই। এই দুই মশাবাহিত রোগ ধীরে ধীরে মানুষের শরীর ও জীবিকায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। চট্টগ্রামে করা নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য।

নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের বাসিন্দারা ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা মাসের পর মাস অস্থিসন্ধির প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন। এতে বিপর্যস্ত রোগীরা।

এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের যৌথ উদ্যোগে চলতি বছরের মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের উপজেলাগুলোর ১ হাজার ১০০ জন চিকুনগুনিয়া ও ১ হাজার ৭৯৭ জন ডেঙ্গু রোগীর ক্লিনিক্যাল, জনস্বাস্থ্য, রোগতত্ত্ব ও জেনেটিক তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষকদের ভাষ্য, দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটি ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ে অন্যতম বিস্তৃত গবেষণা।

রোববার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে নগরের থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন। ‘চট্টগ্রামে ডেঙ্গু, জিকা ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের সার্বিক পরিস্থিতি, জনস্বাস্থ্যে প্রভাব, চিকিৎসাপদ্ধতি ও ভাইরাসের জিনোমরহস্য উন্মোচন’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে চিকিৎসক, গবেষক ও নগর–ব্যবস্থাপনার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, রেলওয়ে হাসপাতালের চিকিৎসক আবুল ফয়সাল মোহাম্মদ নুরুদ্দিন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক আদনান মান্নান।

মাসের পর মাস ব্যথা: গবেষণায় উঠে এসেছে, চিকুনগুনিয়া এখন আর সাময়িক অসুখ নয়। আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৬০ শতাংশের ক্ষেত্রে অস্থিসন্ধির প্রচণ্ড ব্যথা তিন মাসের বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে গোড়ালি, হাঁটু, কবজি ও হাতের অস্থিসন্ধি। অনেক রোগী সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতেই পারছেন না, অস্থিসন্ধি শক্ত হয়ে যাচ্ছে, কোথাও কোথাও ফোলা ভাব দেখা দিচ্ছে। এতে স্বাভাবিক জীবনযাপন তো বটেই, কাজে ফেরা হয়ে উঠছে কঠিন।

ভৌগোলিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৮০ শতাংশই চট্টগ্রাম নগরের বাসিন্দা। কোতোয়ালি, বাকলিয়া, ডবলমুরিং, আগ্রাবাদ, চকবাজার, হালিশহর ও পাঁচলাইশ এলাকায় সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। উপজেলা পর্যায়ে সীতাকুণ্ড, বোয়ালখালী ও আনোয়ারায় তুলনামূলক বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে ডেঙ্গু ও জিকার সঙ্গে একযোগে চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ, যা রোগনির্ণয় ও চিকিৎসাকে কঠিন করে দিচ্ছে।

গবেষকেরা বলছেন, ভুল রোগনির্ণয় ও পর্যাপ্ত রিপোর্ট না হওয়ার কারণে প্রকৃত রোগের চাপ অনেকটাই অজানা থেকে যাচ্ছে। প্রায় ৩০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে সঠিকভাবে রোগ শনাক্ত হয়নি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ। একজন চিকুনগুনিয়া রোগীর পেছনে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অসুস্থতার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ৭ থেকে ৮ দিন কাজে যেতে পারেননি। চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে প্রায় ৭ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীকে ঋণ নিতে হয়েছে।

ডেঙ্গুতে তরুণেরা বেশি ঝুঁকিতে: ডেঙ্গু–সংক্রান্ত গবেষণায় উঠে এসেছে উদ্বেগজনক চিত্র। আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ সতর্কতামূলক লক্ষণসহ ডেঙ্গুতে ভুগছিলেন। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগী গুরুতর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। প্রায় সব রোগীরই জ্বর ছিল। এর পাশাপাশি বমিভাব, মাথাব্যথা, মাংসপেশি ও চোখের পেছনে ব্যথা, পেটব্যথা ও ডায়রিয়ার মতো উপসর্গ ব্যাপকভাবে দেখা গেছে।

জনসংখ্যাগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠী। শিশু-কিশোরদের মধ্যেও সংক্রমণের হার কম নয়। নারীদের তুলনায় পুরুষ রোগীর সংখ্যা বেশি এবং শহরাঞ্চলের মানুষ গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। সহরোগ বিশ্লেষণে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ, কাশি ও শরীরে তরল জমে যাওয়ার মতো জটিলতাও শনাক্ত হয়েছে।

করণীয় কী: অনুষ্ঠানে মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, এটি একটি বড় নগর–ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ। মশার প্রজননস্থল, জলাবদ্ধতা, নগরের অবকাঠামো ও মানুষের আচরণ—সবকিছু বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ না করলে নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম টেকসই হবে না।

অধ্যাপক আদনান মান্নান বলেন, চট্টগ্রামে প্রায় ১২ হাজার রোগীর চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ থাকলেও পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র সাড়ে তিন হাজারের মতো। পরীক্ষার খরচ বেশি হওয়ায় অনেকেই রোগ নির্ণয় করাতে পারছেন না। এই খরচ কমানো জরুরি।

গবেষক এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, শুধু ডেঙ্গুকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। চিকুনগুনিয়াকে সমান গুরুত্ব দিয়ে নজরদারি, সঠিক রোগনির্ণয়, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার না করলে চট্টগ্রামের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর এই রোগগুলোর চাপ আগামী দিনে আরও বাড়বে। সূত্র: প্রথম আলো

চস/স

Latest Posts

spot_imgspot_img

Don't Miss