বাংলাদেশি কেউ একবার ইউরোপ-আমেরিকায় প্রবেশ করলে আর বাংলাদেশে ফিরতে চান না। এর পিছনে যৌক্তিক কারণ কি? এর কারণ এখানে আসার পরে এখানকার কিছু কিছু সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সিস্টেমে আপনি এত মুগ্ধ এবং একীভূত হবেন যে আপনি চাইলেও আর দেশে ফিরার চিন্তা করবেন না। অনেকে প্রশ্ন করেন যে ভাই আপনি তো দেশে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তাহলে আপনি বাংলাদেশ ছাড়লেন কেন? এর উত্তরে আমার বিশেষ উল্লেখযোগ্য কিছু বলার নেই। কিন্তু আপনি যদি কখনো ইউরোপ-আমেরিকার কোথাও এসে এক-দুই বছর বসবাস করেন তখন দেখবেন বাংলাদেশে ফিরার কথা ভাবলেই আপনার মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে যাবে। এর পিছনে অনেক কারণ আছে। তন্মধ্য কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলোর সাথে বাংলাদেশ এবং ইউরোপ আমেরিকান দেশের আকাশপাতাল পার্থক্য।
বাংলাদেশে ফিরতে বিদেশীদের কেন এত দুশ্চিন্তা? এই প্রশ্নটির জবাব একেকজনের নিকট একেকরকম। এই ধরুন আপনি ইউরোপ-আমেরিকার কোথাও বসবাস করছেন, ঘুম থেকে ওঠে বাথরুমে গিয়ে কখনো পানির জন্য আপনাকে দুই সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হবে না। বাথরুমে ঢুকে হাত চাপলেই গরম অথবা ঠান্ডা পানি পাবেন। চব্বিশ ঘন্টা এখানে যে কোন ধরনের পানি এভেইলেবল থাকে।
আমি বিগত আঠারো বছর ধরে ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং কানাডায় বসবাস করছি। কিন্তু কোনদিন পানির প্রবলেমে পড়েছি বলে মনে হয় না। কানাডায় ২০২৩ সালে বাসার সামনে পানি সংযোগের লাইনে মেরামত কাজের জন্য একদিন তিনঘন্টা পানির লাইন বন্ধ রেখেছিল। এইই। এই পানি বন্ধ রাখার জন্য একমাস আগে থেকে সিটি কর্তৃপক্ষ নোটিশ পাঠিয়েছিল।
এমনকি মেরামত কাজের আগেরদিন দরজায় এসে নক করে করে সবাইকে এ ব্যাপারে সিটির লোকেরা আবার বিষয়টি অবগত করে গিয়েছিল। অথচ বাংলাদেশে বিভিন্ন জেলার খবর আমি তেমন জানি না। তবে সিলেট শহরে ফার্স্ট ক্লাস একটি এলাকায় আমি বাসা ভাড়া নিয়ে কয়েক বছর বসবাস করেছি। ঠিকমত কখনো পানি সরবরাহ পাই নি। প্রায়ই বাথরুমে গিয়ে পানির দেখা মিলত না।
এমনকি ঘোসল করতে গেলে অনেকদিন খবর নিতে হত যে বাসার ছাদের টেঙ্কিতে যথেষ্ট পানি আছে কি না! এছাড়া গরম পানির কোন সিস্টেমই ছিল না। বাংলাদেশে সিলেটের মত একটি শহরে যদি ডিপ টিউবওয়েল না থাকে তাহলে আপনি কখনো দৈনিক ব্যবহার্য্যের পানি পাবেনই না? এটি ভাবা যায়?
এছাড়া খাবার ও দৈনিক জিনিসপত্র! বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় এসে এখানকার একেকটি সুপারশপে প্রবেশ করলে আপনার মনে হবে আপনি এই কোথায় এসেছেন, এই কোথায় প্রবেশ করেছেন!
ওয়ালমার্ট, কসকো, টেসকো, লিডি, আলবার্টস্টোন, সেন্সবারী, আজদা, ক্যায়ারফোরের মত ইউরোপ আমেরিকান নামিদামি সুপারশপে কেউ একবার কেনাকাটা করলে আর বাংলাদেশে গিয়ে তাদের পক্ষে শান্তিতে মার্কেটিং করা অসম্ভব।
এছাড়া ফলফ্রুট! ইউরোপ আমেরিকায় এসে যারা একবার বিভিন্ন ধরনের ফলফ্রুটে অভ্যস্ত হয়ে যান তাদের পক্ষে বাংলাদেশে গিয়ে এগুলো ছাড়া বেঁচে থাকা কষ্টকর হবে।
বাংলাদেশের অনেক শহরে ইউরোপ আমেরিকার মত সবধরনের ফলফ্রুট মিলে না। আর যদি কোথাও মিলে তাহলে সেগুলো ইউরোপ আমেরিকার চেয়ে অনেক বেশী এক্সপেন্সিভই মনে হবে।
এছাড়া ট্রান্সপোর্ট! ইউরোপ আমেরিকায় মোটামুটি চাকুরি করলে অনেকের পক্ষে ব্যক্তিগত কার অথবা জীপ গাড়ি চড়া সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে আয়-ব্যায়ের সাথে খাপ খেয়ে কজনের পক্ষে নিজেস্ব গাড়ি চড়া সম্ভব? এজন্য অনেকে একবার পশ্চিমা দেশে পা রাখলে আর পারতপক্ষে কখনো বাংলাদেশে ফিরতে চান না।
অসংখ্য বৈসাদৃশ্যের মধ্যে মাত্র দু-একটি বিষয় উল্লেখ করলাম। এছাড়া বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক হানাহানি, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, পাড়া প্রতিবেশী দ্বন্দ্ব, ধর্মগত দ্বন্দ্ব, ব্যবসাবাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব, একে অন্যে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব সহ অসংখ্য সমস্যা আছে যেগুলো ইউরোপ-আমেরিকায় নেই বললেই চলে।
এসব কারণে কেউ একবার ইউরোপ আমেরিকায় প্রবেশ করলে আর দেশে ফিরতে চান না। যারাই পশ্চিমা দেশে একবার পা রেখেছেন তারাই ঘুরেফিরে এই দেশগুলোতে থেকে যাবার চেষ্টা করেন।
বাংলাদেশের ৮০-৯০ দশকের জনপ্রিয় সব চিত্র তারকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মডেল সবই এখন ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাস করেন। অথচ এরা সবাই বাংলাদেশে বিশাল ক্যারিয়ার ফেলে এসে এখানে দিব্যি সুখে আছেন বলেই মনে হয়।
যদি এখানে সবাই সুখে না থাকতেন তাহলে হয়ত সবাই একসময় বাংলাদেশে ফিরে যেতেন। কিন্তু না যারা একবার ইউরোপ আমেরিকায় পা ফেলেছেন তারা আর কখনো স্থায়ী ভাবে বাংলাদেশে ফিরেন নি।
এ থেকে বুঝা যায় অনেক নামিদামি তারকারাও বিভিন্ন কারনে বাংলাদেশের চেয়ে এখন বিদেশকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। দেশে সুখে থাকলে কেউই এভাবে এসে ইউরোপ আমেরিকায় থাকার চেষ্টা করতেন না।
অথচ ভারতের প্রথম সারির কোন তারকাদের অথবা আমলাদের এভাবে বিদেশ সেটল্ডের প্রবণতা নেই বললেই চলে। কারণ রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে এরা নিজ দেশকেই স্ট্যাবল মনে করছেন বলে ওদের বিদেশে স্থায়ী হওয়ার প্রবণতা কম।
আমার ব্যাপারে কি বলব? আমি আসলে বাংলাদেশে কিছু করার মত কেউ ছিলাম না। নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন পরিস্থিতিতে আমার মত মানুষদের বিদেশে সেটেল্ড হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে আমি মনে করেছিলাম।
পশ্চিমা দেশে কিছু সমস্যা যে না নেই এমনটি নয়। তবে এখানে কেউ আপনাকে যেচে এসে ডিস্টার্ব করবে না। এই সিস্টেমটাই নেই এখানে। আপনি কাজকর্ম করবেন এবং আপনার মত চলবেন। কেউ আপনাকে বদার করবে না এখানে।
পশ্চিমা দেশে চাইলে আপনি চব্বিশ ঘন্টা মসজিদ অথবা মন্দিরে বসে থাকুন কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না। অথবা মদের বারে গিয়ে আপনি টাল হয়ে বাসায় ফিরেন কেউ আপনাকে হেই বলতে পারবে না। এটি এখানকার স্বাভাবিক জীবন।
তবে হ্যাঁ ২০০৬ সালে ইংল্যান্ড এসে ২০১২ সালে আমি একেবারে বাংলাদেশে চলে গিয়েছিলাম যেখানে পুরোপুরি ইচ্ছা ছিল দেশেই সেটেল্ড হব। বাকী জীবনটা দেশেই কাটিয়ে দেব।
কিন্তু ২০১২ থেকে ২০১৫ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক হানাহানি এবং দ্বন্দ্ব দেখে আমি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাবানিজ্য ফেলে আমেরিকায় পাড়ি জমাই।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের দেশ ছাড়ার কারণ হলো অতিরঞ্জিত রাজনৈতিক কার্যকলাপ। এ নিয়ে কথাবার্তা না বলাই ভাল। এতে দেশের এবং দেশের রাজনীতিবিদদের বদনাম হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক কিছু পরিবর্তন ও সংশোধন দরকার। যদি দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও কার্যকলাপ এবং আইনের প্রয়োগ শান্তিপূর্ণ না হয় তাহলে যে ই সুযোগ পাবে সে ই দেশ ছাড়বে।
২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে সিলেট শহরের জিন্দাবাজারের ককটেল বোমার শব্দ এখনো আমার কানে বাজে। সে সময় বাসা থেকে বেরিয়ে প্রতিদিন দোকানে যাওয়া এবং দোকান থেকে ঠিকমত বাসায় পৌঁছানোর জন্য মনে মনে দুশ্চিন্তা করতে হত। সে সময়কার ঐ নারকীয় তান্ডব দেখলে সাধ্যে থাকলে যে কেউই বাংলাদেশ ছাড়তে চাইবে।
আমিও এই একই কারণে পুনরায় দেশ ছেড়েছিলাম। যে দেশে মেধাবী ও সহজ সরল মানুষদের বোকা ভাবা হয় এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাদেরকে ঠকানোর সুযোগ খুঁজে সে দেশে ভালো কিংবা মন্দ কারো পক্ষেই শান্তিতে বসবাস অসম্ভব। এজন্যই দেশ ছেড়েছিলাম।
মো. শায়কুল ইসলাম
মন্ট্রিল, কানাডা
চস/আজহার


