spot_img

৬ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, বুধবার
২২শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সর্বশেষ

বেলালের মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হওয়া হলো না

মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন। বাড়ি বাঁশখালী উপজেলার জলদি এলাকায়। তাঁর জীবনে এখন বইছে বিষাধের বাতাস। একটু পরিষ্কার করে বলতে হলে যেতে হবে একটু পেছনে। তুলে ধরতে হবে বেলালের জীবনের গল্প। এক ভাই ও বাবা-মা মিলে চারজনের পরিবার নিয়ে বেশ সুন্দর জীবন যাপন করছিলো বেলাল। তাঁর বাবার ওষুধের দোকান দিয়ে মোটামোটি বেশ ভালোভাবেই পরিবার চলে। সবমিলেয়ে বেশ সুখের সংসার বলা যায়। কিন্তু একসময় এই সুখের সংসারে নেমে আসে ভয়ংকর অন্ধকার। ভয়ংকর এক অবস্থায় পড়ে বেলালের পরিবার। সময়টা ২০১৮ সাল। বেলালের বাবার পায়ের সামান্য ক্ষত থেকে পুরো পায়ের পাতাটাই পচন ধরে যায়। ডায়বেটিসের কারণে এমনটা হয়েছে বলে ডাক্তারের ভাষ্য। কিন্তু লাখ লাখ টাকা খরচ করেও তার বাবার পা রক্ষা করতে পারেনি। পায়ের পাতাটা শেষ পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়েছে। তবুও সেই ক্ষত শুকায় না বেলালের বাবার। এই হাসপাতাল থেকে সেই হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে দিতে হলো। আত্মীয় স্বজন আর কত দিবে! এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কজন কজনের পাশে থাকে! পরিবারের নেমে আসা আধাঁরটুকু মুছে আলো ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন রোজ দেখে বেলাল। ডাক্তার বলোছিলো বেলালের বাবাকে বিদেশ নিতে পারলে কিছুটা উন্নতি হবে। কিন্তু বেলালের কথা ছিলো এমন, “দেশেই এখন খেয়ে পড়ে বাবার চিকিৎসা করাতে পারছি না। সেখানে বিদেশে কীভাবে!”

এভাবে কোনো রকম এদিক সেদিক করে চলছিলো বেলালের জীবন। এর মধ্যে ২০২১ সালে বেলাল এইচএসসি পাশ করে। এসএসসি এবং এইচএসসি দু জায়গায় ভালো ফলাফল হওয়াতে বেলাল স্বপ্ন দেখেছিলো মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হবে। হয়তো তার পরিবারের দুঃখ কিছুটা ঘুছবে। বাবাকে হয়তো উন্নত চিকিৎসার জন্য একসময় বিদেশেও নিতে পারবে। দু-চোখে হাজার স্বপ্ন দেখা বেলাল কোনো রকম টাকা জোগাড় করে ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষাটা দেয়। কিন্তু রেজাল্ট দেখে কিছুটা মন খারাপ হয়েছিলো তার। অপেক্ষামন তালিকায় তার নাম ছিলো চার নম্বরে। এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরের ২১ তারিখ তার দিনটি ছিলো সাময়িক উৎসবের দিন। অপেক্ষামান তালিকা থেকে সে সুযোগ পেয়েছে সিলেট মেরিন একাডেমীতে। সরকারি ভাবে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হলে ৯৯ হাজার টাকা প্রয়োজন। এটা বেলাল জানতো না। বেলালের পরিবার আত্মীয় স্বজনও প্রথমে মনে করেছে বেসরকারি হবে হয়তো। নয়তো এতো টাকা লাগবে কেন! কিন্তু পরক্ষণে যাচাই করে বিষয়টির সত্যতা পেল সকলে। কিন্তু ভর্তি হওয়ার লাস্ট ডেট ছিলো ২৩ ডিসেম্বর ২০২১। আর ভর্তি হতে হলে ৫০ হাজার টাকা পে অর্ডার করতে হবে। বেলাল এটা শুনেই চুপসে গেলো। মনে মনে হয়তো ভেবেছে আর বুঝি স্বপ্ন পূরণ হলো না। এতো টাকা কোথা থেকে পাবে সে? এরপরও বেলালের মা সন্তানের জন্য নিজের শেষ চেষ্টাটা করেছে। আরও একবার আত্মীয় স্বজনের নিকট টাকা চেয়েছে সন্তানের পড়াশোনার জন্য। না, দান হিসেবে নয়। ধার নিয়েছেন। এই টাকা নিতে নিতে ২৫ তারিখ হয়ে গেল। ২৬ তারিখ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো বেলাল। মতিঝিল, টয়েনবি সার্কুলার রোডে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় অবস্থিত। ঐখানে গিয়ে সর্বপ্রথম মিটুন কুমার সাহার সাথে আলাপ করে। কিন্তু তিনি শুরুতেই বেলালের দরখাস্থ নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

মো. বেলাল উদ্দিন
অসুস্থ বাবার সাথে বেলাল

 

তারপর ক্যাপ্টেন এবং এক্সামিনার দেলোয়ার স্যারের কাছে দরখাস্থ করে। এবং তিনি মোটামোটি আশ্বাস দেন। এরপরে নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের চীফ ইন্জিনিয়ার মনজুরুল কবীরের সাথে যোগাযোগ করে বেলাল। তিনি বিষয়টি নিয়ে না ভেবে এক শব্দে পারবেনা বলে জানিয়ে দেন। এদিকে এক্সামিনার দেলোয়ার স্যারের আশ্বাস পাওয়াতেই বেলাল সন্তুষ্ট। কারণ তিনি বেলালের সমস্ত ঘটনা শুনেছেন। যদিও বেলাল তার দরখাস্থে এসব তুলে ধরেছে। এরপর বেলাল ফিরে আসে বাশঁখালীতে। অপেক্ষা করতে থাকে কখন ফোন আসে। কিন্তু দিনের পর দিন পার হয়ে যায় কোনো খোঁজ নেই। বেলাল সবসময় মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে, এই বুঝি ফোন আসতে পারে। কিন্তু সেই ফোন আর আসে না।

এরপর নতুন বছর চলে আসে। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে আর না পেরে একদিন বেলালের খালাতো ভাই ফোন দিয়ে জানতে চায় বেলালের বিষয়ে। এরপর যা খবর আসে তাতে বেলাল এবং বেলালের পরিবার হতভম্ব হয়ে গেলো। বেলালের স্বপ্নটা মূহুর্তেই দুমড়ে-মুছড়ে গিয়েছে। কিছু সময়ের জন্য চোখের জল গড়িয়েছে বেলালের। এই বযসে এসে বেলালের চোখে জল খুব একটা দেখা যায়নি। তবে এবার আর জল আটকাতে পারেনি বেলাল। বেলালের খালাতো ভাই যখন ফোন দিয়েছে বেলালের খবরটা জানার জন্য। তখন মিটুন কুমার সাহা বলেন, বেলাল নির্ধাারিত সময়ের মধ্যে ভর্তি হতে পারেনি তাই তাকে সুযোগ দেওয়া যাবে না। তার দরখাস্থ কেন নেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “দেখুন আমরা তার জন্য মিটিং বসেছি। যেখানে আমাদের সচিব স্যার নিজে উপস্থিত ছিলেন। তিনিই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নির্দিষ্ট সময়ের পর কাউকে আর ভর্তির সুযোগ দেওয়া হবে না।”
বেলালের খালাতো ভাই যখন বলছিলো বেলালের সমস্যাটা আপনারা জানেন। তার বিষয়টা কি মানবিক ভাবে দেখা যায় না? উত্তরে তিনি সেই একই কথা বলেন। সবশেষে তিনি বলেন বেলালের বিষয়ে তিনি কোনো সহয়োগিতা করতে পারবেন না।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ, অথচ এই আমাদের দেশের চিত্র। যেখানে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী অর্থের অভাবে পড়তে পারে না নিজের পছন্দের মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং। যখন অর্থের ব্যবস্থা হলো তখন আর মানবিকতার দেখা পায়নি বেলাল। এতো পরিশ্রম, এতো কষ্ট সবকিছুই বৃথা। এই অমানবিকতা আরও কত বেলালের সাথে হয়েছে সেটা হয়তো বেলাল জানে না। কিন্তু বেললের কষ্টটা বেলাল কোনোভাবেই ভুলতে পারছে না। ভুলতে পারছে না তার পরিবার। বেলালের বাবার চিকিৎসা আর পরিবারকে নিয়ে সকল স্বপ্ন ভেস্তে গেলো এই এক ঘটনায়। এভাবেই অনেক বেলালরা হেরে যায় নিয়মের বেডাজালে। অথচ এসব বেলালরাই আগামী দিনের বাংলাদেশ।

 

Latest Posts

spot_imgspot_img

Don't Miss