আমার সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। পাশে ঘুমনোর সময় যদি বাবার পায়ের ওপর পা না রাখতাম, বলত – ‘সারাদিন এত হাঁটাহাঁটি করেছি, একটু পায়ের ওপর পা’টা রাখতে পারছিস না।’ কিংবা কোনদিন হয়তো অফিস থেকে খুব ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছি। রাতে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছি। চোখের চশমা খোলা হয়নি। বুকের ওপর বইটা খুলে রাখা আছে। ঠিক রাত দুটো আড়াইটে নাগাদ বাবা এসে সব ঠিক করে দিয়ে, গায়ে চাদরটা ভালো করে টেনে দিয়ে, মাথার কাছে চলতে থাকা রেডিওটা বন্ধ করে দিয়ে, খুব সাবধানে দরজাটা বন্ধ করে চলে যেত। আমার ঘুমটা ভেঙে যেত ঠিকই, কিন্তু চুপ করে আমি শুয়ে থাকতাম। বাবার যাওয়ার সময় নইলে মাথায় হাত বোলাবে না যে।
একবার মনে আছে, কলেজ থেকে স্পন্সরশিপে প্রথমবারের জন্য ইউরোপ যাচ্ছি। ভালো জুতো নেই। এসপ্ল্যানেড মোড়ে একটা বাটার শোরুম আছে। আমি বিধান মার্কেট গিয়েছিলাম কাগজ কিনতে। ফেরার পথে বাটার দোকানে ঢুকি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা জুতো বেশ পছন্দ হয়। তখন আমি টিউশনি করি আর নানান বিজ্ঞাপন অফিসে ফ্রিল্যান্সিং করি। জুতোটা ছিল নর্থ স্টার কোম্পানির। আমার পায়ের মাপ এগারো। তাই ওই জুতোটাই সবথেকে ভালো ফিট হয়েছে। ইউরোপে শুনেছিলাম খুব হাঁটতে হয়। তাই একটু ভালো মজবুত জুতোর প্রয়োজন। দাম লেখা রয়েছে পনেরোশো পঞ্চাশ। বুকটা ধক করে উঠল। দোকান থেকে বেরিয়ে গ্র্যান্ড হোটেলের নিচে দাঁড়িয়ে, বাবাকে ফোন করলাম। জানি দুপুরে বাবা একটু বিশ্রাম নেয়, তবুও ফোন করলাম। “একটা জুতো আমার পায়ে খুব ভালো ফিট হয়েছে। কিন্তু দাম বলছে পনেরোশো পঞ্চাশ। কি করি বলো তো?”
বাবা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘তুই সত্যিই এটা জিজ্ঞেস করার জন্য ফোন করেছিস?’ আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, ‘এত দাম দিয়ে কি করে তোমায় জিজ্ঞেস না করে কিনবো? আগে কখনও এত দামী জুতো পরিনি।’ বাবা এবার হাসছে। ‘তুই নিজে এখন রোজগার করছিস। সেই টাকায় জুতো কিনবি। তাও ফোন করে জিজ্ঞেস করছিস। মানুষ হয়ে গেলি যে রে! একদম ভাবিস না কিনে ফেল। যদি আরও টাকা লাগে, আমি দিয়ে দেব। তুই যে ইউরোপ যাচ্ছিস। তোর পায়ের এখন অনেক দাম। ভাবিস না একদম!’
এই ছবিটা প্রিয়ম তুলেছিল। বাবার তখন শরীর খুব খারাপ। হাত কাঁপত বলে দাড়ি কাটতে পারতো না। একটা বিয়েবাড়ি গিয়েছিলাম আমরা। বউভাতের দিন সকালে বাবার যখন দাড়ি কাটছি, দেখলাম চোখ বন্ধ করে বসে আছে। আমার বউকে বলল, – ‘ছেলেটা কেমন যত্ন করে দাড়িটা কাটছে দেখ। আমার সেলুনের নাপিতকে ছবিটা পাঠিয়ে দাও। দেখে শিখুক ব্যাটা।’
শুভ জন্মদিন বাবা। যেখানেই থেকো, ভালো থেকো। আলোয় থেকো।
(ফেসবুক থেকে নেওয়া)
চস/আজহার