সারাহ রাহনুমা নামে ভীষণ উদ্যোগী একজন তরুণী আজ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। স্বেচ্ছা বিদায়। আমার খুবই খারাপ লাগছে। মেয়েটাকে চিনতাম বছর দশেক ধরে। ক্যানাডা আসার পর ২০১৭ সালে আমার সাথে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল। খুবই স্ট্রেসড থাকত সেই সময়ে। প্রচন্ড ডিপ্রেসড। ওই সময়ে একটা ছবি ইনবক্সে দিয়ে বলেছিল আমার আর আমার মেয়ের সাথে তার বইপোকার আড্ডাখানার একটা প্রোগ্রামে দেখা হয়েছিল। আমার একদম মনে ছিল না, খুব অবাক হয়েছিলাম।
আজকে ওর মৃত্যুর পর ইনবক্সের কথাগুলো পড়লাম, ছবিগুলো দেখলাম। জিটিভিতে কাজ করত। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ছিল। এই বন্যাতেও তাদের নিজস্ব একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ফেনী-নোয়াখালীর উদ্ধারকাজে অংশ নিচ্ছিল। CricMac নামে ক্রিকেটের একটা জনপ্রিয় পেইজও সে শুরু করেছিল। তার ওয়ালে গিয়ে দেখলাম গত এক মাসে তার বেশ কিছু পোস্টে হতাশার পরিষ্কার ইঙ্গিত। নিজের উপর তীব্র রাগ হচ্ছে কেন পোস্টগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়িনি। পড়লে হয়ত কথা বলতে পারতাম। একটা ফোন করতে পারতাম। আমার একটা ফোনে সে জীবনের বিতৃষ্ণা ভুলে যেত মনে করি না, কিন্তু চেষ্টাটা তো করতে পারতাম।
এমন অনেকবার হয়েছে ফেইসবুকে কারও হতাশার পোস্ট দেখে সাথে সাথে তাকে নক করেছি। চিনি না কিন্তু কথা বলেছি, জানিয়েছি কখনও খারাপ লাগলে, কষ্ট লাগলে যাতে জানায়। এমন অনেক মানুষকে নানাভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করি, তাদের কাজে, জীবনে, কোন প্রতিদানের বা রিকগনিশনের আশায় নয়, স্রেফ এই আশায় যে হতাশ মানুষটি উঠে দাঁড়াবে। ফেইসবুকে নিজের কাজ, লেখালেখি গত বছর দুয়েকে অনেক গুছিয়ে এনেছি। কয়েক দফায় হাজার হাজার ব্যক্তিকে বন্ধু থেকে দুরবর্তী পন্ডিতের আসনে উঠিয়ে দিয়ে তালিকা আড়াই হাজারে নামিয়ে এনেছি। তারপরও নানা মানুষ অকারণে ত্যক্ত বিরক্ত করায় এই আড়াই হাজারেরও প্রায় ৯০ শতাংশকে আনফলো করে রেখেছি। এইসব করতে গিয়ে অনেক সময় ভাল পোস্টও নোটিফিকেসনে আসে না।
আমার ১৫ বছর বয়সী ফেইসবুকে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করা মানুষের সংখ্যা এখন দশের কাছাকাছি। মৃত মানুষ কয়েক ডজন। সেগুলো বেশীরভাগ রয়ে গেছে তালিকায়। রাহমুনা সারাহ আরেকটা নাম হয়ে যুক্ত হলো।
একেকটা মানুষ চলে যায় আমার ভীষণ কষ্ট হয়; হোক না কাছের কিংবা দূরের। মানুষের কষ্টের কারণ যাতে না হই সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি গত ৩-৪ বছর ধরে। একান্ত নিজের মনে না করলে কারও ওয়ালে যেয়ে কোন কমেন্ট করি না, তর্ক-বিতর্ক করি না। ভীষণ ভিন্নমতের হলেও তার সাথে অন্যের ওয়ালে যেয়ে ঝগড়ায় মাতি না। জানি প্রতিটা মানুষের একান্ত নিজস্ব কিছু দুঃখ আছে। সেগুলোর প্রকাশ তারা ঘটায় অন্যের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংঘাতে জড়িয়ে। অথচ তারা নিজেরাও জানে না যে তাদের এই আগ্রাসী আচরণের কারণ তাদের নিজেদের জীবনের নানা ঘটনা, কোন একটা লুকায়িত Trauma.
গতকাল এক বন্ধুকে বলছিলাম দেশের সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে যে শত শত ছাত্র মারা গেছে, তাদের সেই মৃত্যুর বিভীষিকাময় স্মৃতি ধারণ করে আছে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে। ২০-২৫ বছরের এইসব শিক্ষার্থীরা বুকের মধ্যে ভয়াবহ এক দগদগে ঘা নিয়ে বেড়ে উঠবে, তাদের মধ্যবয়সে অনেক সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলবে এইসব কালরাত্রির স্মৃতি। ৪ অগাস্ট ২০২৪, শেখ হাসিনার পতনের আগের দিন প্রায় ৫ ঘন্টার এক ভীষণ বিষণ্ণ আলাপচারিতায় টরোন্টোর কোন এক রেস্তোরায় বন্ধু সিমু নাসেরকে বলছিলাম এইসব শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের কাজ করা উচিৎ। সিমু লেখাটা পড়লে কল দিস, এই বিষয়ে কথা বলা দরকার। আসিফ সালেহ ভাইকেও একটু মনে করে বলিস।
Childhood trauma একটা ভয়াবহ জিনিস। আমি যখন ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোতে Child Health পড়াই, তখন এই জিনিসগুলো আলোচনা করতে হয়, অনেক ছেলেমেয়ে তাদের অভিজ্ঞতা এসে জানায়। আমাদের অনেক দুর্ব্যবহার, রাগ, ক্ষোভ, অনৈতিকতার সূত্রপাত আমাদের শৈশব-কৈশোরে ঘটে যাওয়া কোন দগদগে ক্ষত থেকে সৃষ্ট। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ম্যাসিভ আকারে কাজ করা দরকার। কেউ করতে চাইলে আমি পাশে থাকতে চাই।
সারাহ রাহনুমা তো চলেই গেল। একটা খুব ক্ষুদ্র জীবনের সমাপ্তি। সারাহ যে চলে গেল সে তো সেটা জানল না, অনেকটা দুপুরবেলার গভীর ঘুমের মতো, কিন্তু তার চলে যাওয়া আক্রান্ত করে গেল আমাদের। ওপারে ভাল থেকো, এটি কখনও আমি বলি না, যেমন ঘুমুতে যাওয়ার সময় কাউকে বলি না, ঘুমের মধ্যে ভাল থেকো।
যারা বেঁচে আছে, তারা ভাল থাকুক। আমাদের বিষাদে আক্রান্ত করে কেউ এভাবে আর না চলে যাক। আমার একটা কুখ্যাতি আছে আমি ফোন ধরি না। কিন্তু আমার তালিকা বা তালিকার বাইরের কেউ যদি এমন বিষাদের মধ্য দিয়ে যান, আর মনে হয় বেঁচে থাকা অর্থহীন, দয়া করে দুটি কাজ করবেন। ১) যাদের সাথে কথা হলে আপনার ভাল লাগে না, কষ্ট হয় – তাদের জীবন থেকে ছেঁটে ফেলুন, দ্বিধা করবেন না, আমি দীর্ঘ সময় দ্বিধা করে এখন আর এ ব্যাপারে সময় নিই না, ছেঁটে ফেলি। ২) কাছের কারও সাথে কথা বলুন, যার সাথে কথা বললে আপনার ভাল লাগে। তাকে দরকার হলে জোর করে কথা বলুন। যদি কথা বলার কেউ না থাকে, আমাকে জানাবেন। আমি কথা বলব। প্রতিটা মানুষই ভীষণ সব একাকীত্বের গল্প নিয়ে বেড়ে ওঠে। হতাশ হবেন না। জীবন একটাই। এখানেই শেষ। শেষটা দীর্ঘ হোক, সুন্দর হোক। চলুন কথা বলি।
লেখক
শামীম আহমেদ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ
(লেখাটি শামীম আহমেদের ফেসবুক থেকে নেওয়া)
চস/আজহার