spot_img

৩০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, বৃহস্পতিবার
১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সর্বশেষ

মুক্তিযোদ্ধা মায়ের চিঠি

তখন ১৯৫২ সালের শেষ মাস। রক্তমাখা রাজপথে ভাষা শহিদের রক্তে লেখা বর্ণমালা শুকায়নি। রাফির বাবা এই শহরের শিল্পপতি। রাফি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। রাফির বাবা আরেকটি বিয়ে করবেন। রাফির মা তাকে বারন করলেন। বললেন, তুমি বিয়ে করবে না, যদি করো তাহলে, আমি একমাত্র ছেলে রাফিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো। শেষ পর্যন্ত রাফির বাবা আরেকটা বিয়ে করেই ফেললেন ! রাফির মা আফিয়া তার পুত্রের হাত ধরে ওই প্রাসাদ পরিত্যাগ করেন এবং একটা ছোট্ট কূঁড়ে ঘরে আশ্রয় নেন। ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে থাকেন।

রাফি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে।

১৯৭১ সাল ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই,তার বন্ধুরা যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। তারা ঢাকায় গেরিলা অপারেশন করে। বন্ধুরা রাফিকে বললো, চল,আমাদের সাথে,অপারেশন করবি। তুই তো বন্দুক পিস্তল চালাতে জানিস।

রাফি বললো, এই জগতে মা ছাড়া আমার কেউ নেই, আর মায়েরও আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মা অনুমতি দিলেই কেবল আমি যুদ্ধে যেতে পারি। রাফি মাকে বললো, মা, আমি কি যুদ্ধে যাব? মা বললেন, নিশ্চয়ই, তোমাকে আমার প্রয়োজনের জন্য মানুষ করিনি, দেশ ও দশের জন্যই তোমাকে মানুষ করেছি।

রাফি যুদ্ধে গেলো। দুটো অপারেশনে অংশ নিলো। তাদের বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হলো। গেরিলারা আশ্রয় নিলো। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট। ধরা পড়ে ক্র্যাক প্লাটুনের একদল সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। সে সময় রাফিকেও আটক করা হয়। তাকে ধরে নিয়ে রাখা হলো রমনা থানা সংলগ্ন ড্রাম ফ্যাক্টরি এক মিলিটারি টর্চারসেলে।

গরাদের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা রাফিকে দেখতে গেছেন তার মা। চিনতে পারেন না। প্রচণ্ড মারের চোটে চোখমুখ ফুলে গেছে, ঠোঁট কেটে ঝুলছে, ভ্রুর কাছটা কেটে গভীর গর্ত হয়ে গেছে।

মা, কি করবো? এরা তো খুব মারে। স্বীকার করতে বলে সব। সবার নাম বলতে বলে।

বাবা, তুমি কারোর নাম বলোনি তো ?

না মা, বলি নাই। কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরও মারে, যদি বলে দেই…

বাবারে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো। কারো নাম বলো না। দেশটা স্বাধীন হতে দাও। অনেক শোষন করেছে ওরা। আর না!

আচ্ছা মা। মাগো তোমার হাতে ভাত খেতে খুব ইচ্ছে করছে। তোমার কোলে মাথা রেখে শুতে মন চাইছে। দুইদিন ভাত খাই না। কালকে দুইটা রুটি দিয়েছিল। আমি খেতে পারি নাই। রাফির করুন কথাগুলো মায়ের হৃদয়ে আঘাত করতে লাগলো। তাই আচ্ছা, কালকে ভাত নিয়ে আসবো বলে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।

আফিয়া বেগমের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক, ছেলের গায়ে একটা ফুলের টোকা লাগতে দেননি কোনোদিন। সেই ছেলেকে ওরা এভাবে মেরেছে!

পরদিন, মুরগির মাংস, ভাত, আলুভর্তা আর বেগুনভাজি টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে সারারাত রমনা থানায় দাঁড়িয়ে থাকেন আফিয়া বেগম। কিন্তু রাফিকে আর দেখতে পাননি। তেজগাঁও থানা, এমপি হোস্টেল, ক্যান্টনমেন্ট-সব জায়গায় খুজলেন, হাতে তখন টিফিন ক্যারিয়ার ধরা, কিন্তু রাফিকে আর খুঁজে পেলেন না। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন”রাফিকে” তার বন্ধুরা মুক্ত করে ঢাকার বাহিরে নিয়ে গেছে যুদ্ধ করতে !

ছেলে এক বেলা ভাত খেতে চেয়েছিল। মা পারেননি ছেলের মুখে ভাত তুলে দিতে। সেই কষ্ট-যাতনা প্রতিটা মুহূর্ত তাকে যন্ত্রনা দিচ্ছে ! প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা ছেলেকে ভাত খাওয়াবেন বলে পথ চেয়ে বসে থাকেন আফিয়া। বিশ্বাস ছিলো তাঁর রাফি ফিরবে।

১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। লাল সবুজের বিজয় পতাকা পতপত করে বাংলার আকাশে উড়তে লাগলো ! চারদিকে আনন্দ মিছিল আর মিছিল। তিনি গর্ব করে বলছেন আমিও একজন বীর “মুক্তিযোদ্ধার মা”। তিনি অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছেন এবার দেশ স্বাধীন হয়েছে, যুদ্ধ শেষ হয়েছে। আমার রাফি ফিরে আসবে! না জানি ছেলে আমার কেমন হয়েছে, শুকিয়ে গেছে আরও কতো কল্পনায়।

আফিয়া বেগম মনে মনে তারই বান্ধবী “সুফিয়ার” মেয়ে “আলিয়াকে” রাফির বউ করে নিবেন বলে ছেলের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছেন।

একদিন দু’দিন করে সপ্তাহ,মাস, বছর গড়িয়ে আজ প্রায় অর্ধ-শতাব্দী হলো রাফি আজও ফিরে নি। দূর থেকে যাকেই দেখেন তাকেই তার রাফি মনে করে এগিয়ে যান মা ! আজও আফিয়া বেগম তার রাফির জন্য প্লেটে ভাত নিয়ে অপেক্ষায় বসে আছেন।

মাথার চুলগুলো কালো থেকে ধবধবে সাদা রঙ ধারন করেছে। এখন আর দু’পায়ে চলতে পারেন না। তিন পায়ে ভর দিয়ে চলেন। লাঠিতে টুকটুক করে পাড়ার ছেলেদের পেলেই বলেন আমার রাফিকে তোরা দেখেচিস !!

আজ শরিরটা কেমন করছে, ভাবলেন যদি হঠাৎ আমি মারা যাই, আর আমার রাফি ফিরে আসে তাহলে ও যাবে কোথায় ? কি করবে? তাই, তিনি কাগজ কলমে কাঁপাকাঁপা হাতে একটি পত্র লিখলছেন, রাফির বাবার কাছে। যদিও অনেকদিন যোগাযোগ না থাকায় আজ জানেন না রাফির বাবা বেঁচে আছেন কি না।

ওগো শোনো- আশা করি ভালো আছো। তোমার সুখের জন্যই এতোদিন আমি তোমা থেকে অনেক দূরে ছিলাম। কিন্তু আমার অবর্তমানে তোমার রাফি যে একেবারে নিঃস্ব। যে মা ই তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। আজ আমি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছি যেকোনো মুহুর্তে আমার বিদায় ঘন্টা বেজে যাবে। তোমার ছেলে রাফি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধার বাবা আর আমি মুক্তিযোদ্ধার মা। কিন্তু, সে আজও জানেনি তার বাবা শহরের একজন নামী-দামী শিল্পপতি। আজ আমি পত্রের মাধ্যমে তোমার কাছে রেখে গেলাম তোমার সেই ছোট্ট খোকা আজকের বীর মুক্তিযোদ্ধা রাফিকে।

যদি কোনোদিন আমার এই পত্র হাতে তোমার ছেলে বলে সামনে দাঁড়ায়, তাহলে প্লিজ তুমি তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিও না। কাছে থেকে পিতার স্নেহ-আদরটুকু দিয়ে বুকে টেনে নিও। আমার রাফি যে, সারা জীবন তুমি পিতার আদর থেকে বঞ্চিত! তুমি তাকে তাড়িয়ে দিও না।

আর আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার রাফিকে তুমি তোমার ছেলের আসন থেকে বঞ্চিত করো না এটা আমার শেষ আবদার !

ইতি-

মৃত্যুর পথযাত্রী

তোমার আফিয়া।

 

 

লেখক : গল্পকার

Latest Posts

spot_imgspot_img

Don't Miss