বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে এতদিন মূল নজর ছিল পশ্চিমবঙ্গে। দুই দেশের মধ্যে প্রথম বাস সার্ভিস চালু হয়েছিল ঢাকা-কলকাতার মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে বয়ে যাওয়া তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা চলছে এখনও। এমনকি গত বছরও পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতীতে এসে ‘বাংলাদেশ ভবন’-এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে দিল্লিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গের বদলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ‘ফোকাস’ এখন ধীরে ধীরে ত্রিপুরার দিকে সরে যাচ্ছে। তাদের এ বক্তব্যের পক্ষে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের দেওয়া দুটি বক্তব্যের কথা বলছেন।
গত ৯ অক্টোবর ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ত্রিপুরা যদি কিছু চায় তাহলে তা আমাদের দিতেই হবে। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশের মানুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের বড় ঘাঁটি ছিল ত্রিপুরা, তারা ছিল আমাদের বড় শক্তি।’
আর ৫ অক্টোবর বিপ্লব দেব টুইট করেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উভয় দেশই উন্নতির শিখরে পৌঁছুবে। আপনাদের মধ্যে হওয়া আজকের বৈঠকের ফলে সর্বাধিক সুফল পাবে ত্রিপুরা। আমি ৩৭ লাখ ত্রিপুরাবাসীর পক্ষ থেকে আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দুই মন্তব্য থেকেই পরিষ্কার শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সম্পর্ক আলাদা উচ্চতায় পৌঁছেছে। এলপিজি রফতানি, ফেনী নদীর পানি কিংবা চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের এসওপি-সহ দুই দেশের মধ্যে যেসব সমঝোতা হয়েছে, ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুফল পাচ্ছে ত্রিপুরাই।
শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক দিল্লি সফরের সময় ঘটা বেশ কিছু ঘটনার কথাও বলছেন বিশ্লেষকরা।
(ক) শেখ হাসিনা যেদিন দিল্লিতে পা রাখেন (৩ অক্টোবর), সেদিন রাতেই তার সঙ্গে দেখা করেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব। দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের দেওয়া নৈশভোজে দুজনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। অথচ শেখ হাসিনার এবারের সফরে আরেক সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে দিল্লিতে দেখাই যায়নি।
(খ) শেখ হাসিনা ও বিপ্লব দেবের মধ্যে আলোচনায় ঢাকা-আগরতলা সরাসরি ফ্লাইট নিয়ে পর্যন্ত আলোচনা হয়েছে। (যদিও দুই শহরের মধ্যে দূরত্ব মাত্র ১৩০ কিলোমিটার) বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এখন সপ্তাহে ৬১টি ফ্লাইট চলে। আগামী বছরের মধ্যে তা দ্বিগুণ করার কথা বলা হয়েছে যৌথ বিবৃতিত। নতুন ফ্লাইটগুলোর বেশির ভাগই চলবে আগরতলাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন শহরের সঙ্গে।
(গ) তিস্তা চুক্তির জটিলতা না কাটলেও বাংলাদেশ ফেনী নদী থেকে ত্রিপুরার সাব্রুম শহরকে পানীয় জল দিতে রাজি হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এর মাধ্যমে ঢাকা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকেও পরিষ্কার বার্তা দিতে চেয়েছে।
(ঘ) তিস্তা চুক্তি যখন প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাধাতেই আটকে আছে, তখন ফেনীসহ আরও ৭টি অভিন্ন নদীর পানিসম্পদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক তৈরিতে দুই দেশই একমত হয়েছে। মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতীর মতো নদীগুলোর অধিকাংশই বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত।
(ঙ) বাংলাদেশ থেকে যে বাল্ক এলপিজি আমদানি করে ত্রিপুরার বিশালগড়ে সিলিন্ডারজাত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটাও হয়েছে ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে রান্নার গ্যাস জোগানোর কথা মাথায় রেখে।
(চ) চট্টগ্রাম বন্দর ভারতের ব্যবহার করার ক্ষেত্রে যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর নির্ধারিত হয়েছে, তার সুফলও সবচেয়ে বেশি পাবে ত্রিপুরা ও মিজোরাম। এখানেও ত্রিপুরাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দর বাংলাদেশকে ব্যবহার করার প্রস্তাব নিয়ে তেমন কোনও অগ্রগতি হয়নি।
দিল্লির জেএনইউ-তে সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের প্রধান অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলেন, ‘সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ফ্রেমওয়ার্কে ত্রিপুরাকেই যেন এখন নতুন পশ্চিমবঙ্গ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বন্ধুপ্রতিম একটা দেশের সঙ্গে ভারতের একটি সীমান্তবর্তী অঙ্গরাজ্যের সম্পর্ক আসলে ঠিক কেমন হওয়া উচিত, ত্রিপুরাকেই যেন তার রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে। এবং পশ্চিমবঙ্গকে দেখিয়ে নীরবে বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে, সম্পর্কটা কেমন হওয়া উচিত নয়!’
প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক নীরজা চৌধুরী এর সঙ্গেই যোগ করছেন, ‘বছর দেড়েক আগে ত্রিপুরায় প্রথমবারের মতো বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সচেতনভাবে এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। আসামেও বিজেপির সরকার আছে। তবে এনআরসি-র কারণে যেহেতু আসাম সম্পর্কে বাংলাদেশের কিছুটা অস্বস্তি আছে, তাই এখানে সচেতনভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে ত্রিপুরাকেই।’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থানের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, ‘উল্টোদিকে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের কাছ থেকে কোনও সহযোগিতা তারা পাচ্ছে না, এর মাধ্যমে সেটাও বোঝাতে পারছে।’
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে যদি বিজেপি ক্ষমতায় আসে তখন হয়তো ছবিটা পাল্টাতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চস/আজহার