spot_img

১লা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, মঙ্গলবার
১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সর্বশেষ

আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজ ও দায়বদ্ধতা

সেই ছোটকাল থেকে আমাদের সবার পরিচিত একটি বাক্য হচ্ছে শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন দেশ বা জাতি উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌছাতে পারেনা। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। কথাটি ঠিক যেমন বাস্তব, তেমনি অবাস্তবও বটে। কারণ শুধু শিক্ষা অর্জন করলেই জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয় বরং শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি সুশিক্ষিত হওয়াটাও জরুরী। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হার্বার্ট স্পেনসার শিক্ষার গূঢ়ার্থ বিশ্লেষণে মন্তব্য করেছেন, ‘শিক্ষা একটি শিশুকে প্রকৃত জীবন যাপনের উপযোগী করে তুলতে পারে। শিক্ষা একটি শিশুকে প্রশিক্ষণ দেবে কীভাবে সে শরীর প্রতিপালন করবে, কীভাবে মনের উৎকর্ষ সাধন করবে, কীভাবে দৈনন্দিন বিবিধ সমস্যাকে যুক্তি ও বুদ্ধির সহায়তায় সমাধান করবে, কীভাবে পরিবারের তথা পরিজনের ভরণ-পোষণ বা রক্ষণাবেক্ষণ করবে এবং সর্বোপরি কীভাবে নিজেকে একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষা হলো জীবন-দর্শন। আর সুশিক্ষা হচ্ছে আমাদের শিক্ষা অর্জনের যাবতীয় কার্যকলাপের ফল। অর্থাৎ আমাদের নীতি-নৈতিকতা, সৎ চরিত্রের অধিকারী হওয়া, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতাসহ সকল ধরনের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে সুশিক্ষা।

এই শিক্ষাই যদি জাতির মেরুদন্ড হয় তাহলে শিক্ষকরা হবেন জাতির উন্নয়ন বা মেরুদন্ড গড়ার কারিগর। জাতির উন্নয়ন বা মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষকরা যদি বিবেচিত হয়ে থাকে তাহলে তাদের সকল কর্মকান্ড হবে একটি জাতির পথপ্রদর্শক। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে আদৌ কি জাতির মেরুদন্ড গড়ার কারিগররা পথপ্রদর্শক স্বরূপ হিসেবে বিবেচিত নাকি জাতির জন্য অভিশাপ স্বরূপ ? অথচ এই মহান পেশা সুপ্রাচীন কাল থেকে যুগ যুগ ধরে সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আসছে। সবাই পরম মমতায়, মর্যাদায় ও ভালোবাসার চাদরে আগলে রাখছে পুরো শিক্ষক সমাজ ব্যবস্থাকে। কিন্তু সম্প্রতি, আমাদের দেশের কিছু শিক্ষকরা বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পুরো শিক্ষক সমাজ ব্যবস্থা। তাদের নীতি নৈতিকতা অবক্ষয়ের কারণে আজ শিক্ষক সমাজ ব্যবস্থায় অন্ধকারের ছায়া নেমে এসেছে। কলুষিত হচ্ছে মহান পেশার অতীতের গৌরব ও মর্যাদার। সবার মুখে মুখে তাদের প্রতি ধিক্কার প্রতিবাদের সুর। এই তো সেদিনের কথা, বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধর। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে চাকরি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের মতো নিকৃষ্টতম কাজের। যেখানে আমাদের দেশে উন্নয়নের জন্য বড় বাধা হিসেবে বেকারত্বকে দায়ী করা হয়। আর সেই বেকারত্ব দূর করতে চাকরি প্রত্যাশীরা তাদের আত্মকর্মসংস্থান তৈরি করার জন্য চাকরির পরীক্ষা দিয়ে থাকে। কিন্তু এমন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আদৌ বেকারত্ব দূর হবে কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শিক্ষকতার মতো সুমহান পেশাকে পুঁজি করে এমন ঘৃণিত কাজ করা সত্যিই হতাশাজনক। এছাড়াও রাজনগরে মহলাল প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। স্কুলের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে উন্নয়ন কাজের নামে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী গরিব, অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মোবাইল ঠিকমতো ব্যবহার করতে না জানা এবং অনেকটা বিশ্বাস করে প্রধান শিক্ষক আবু ইব্রাহিমের মোবাইলের সহায়তায় উপবৃত্তির টাকা পাওয়ার জন্য সরল বিশ্বাসে প্রধান শিক্ষকের মোবাইল নম্বর উপবৃত্তির কাজে ব্যবহার করেন। এ সুযোগে বিদ্যালয়ের গরিব শতাধিক শিক্ষার্থীর সরকারি উপবৃত্তির টাকা প্রধান শিক্ষক নামে বেনামে সিম ব্যবহার করে মোবাইলে সংগ্রহ করে আত্মসাৎ করেছেন। অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধর ও রাজনগরে মহলাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু ইব্রাহিমের মতো আমাদের দেশে আরো বহু শিক্ষক রয়েছে যারা কিনা এই মহান পেশাকে পুঁজি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। অথচ তাদের উচিত ছিল, যারা এসব ঘৃণিত কাজে লিপ্ত হবে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ গড়ে তোলা। কিন্তু এখন নিজেরাই সেই দোষে দোষী। যা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এসব প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অপকর্মের অভিযোগে বিভিন্ন শিক্ষক অভিযুক্ত হওয়ার দৃশ্য দেখতে পাই।

এখন প্রশ্ন ওঠে সুমহান পেশায় নিয়োজিত থেকে কেন শিক্ষকরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন ? কেন বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে যান? এর কারণ যদি খুঁজতে যাই তাহলে অনেক কারণ বেরিয়ে আসবে। আর এর পিছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে বর্তমান বাজারব্যবস্থা ও শিক্ষকদের নীতি নৈতিকতার ভিত্তি বা সুশিক্ষার অভাব। শিক্ষকদের বেতন ভাতা, সাম্প্রতিক বেতনবৃদ্ধির পরেও অপর্যাপ্ত। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কিছু শিক্ষকদের অপকর্মের কারণে তাদের নীতি নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার প্রশ্ন ওঠে। তাদের সামাজিক মর্যাদাও তলানির দিকে। যদিও এটি তাদের মধ্যে কিছু শিক্ষকদের কৃতকর্মের ফল স্বরূপ। পাশাপাশি জীবনযাত্রার মান হচ্ছে কঠিন থেকে আরো বেশী কঠিন। চিকিৎসা এবং আবাসন ব্যবস্থায় ব্যয়বহুল হচ্ছে। যার কারণে কিছু শিক্ষক বাধ্য হচ্ছেন দুর্নীতিতে জড়াতে। অনেকেই আবার কোচিং বাণিজ্যে নাম লেখাচ্ছেন। বিভিন্ন নামে বেনামে কোচিং সেন্টার খুলে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। তবে এখনো বড় সংখ্যার শিক্ষকরা দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে, সুমহান পেশার আদর্শটাকে ধরে রেখে শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন। দিনশেষে এরাই প্রকৃত অভিভাবক, এরাই প্রকৃত শিক্ষক। তারা তাদের দায়বদ্ধতা থেকে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ গড়ে তুলছে। কারণ তাদের সেই মনুষ্যত্ববোধ রয়েছে বলে নিজেকে অপকর্ম জড়ায়না।

পরিশেষে বলতে চাই, শিক্ষকতার মতো সুমহান পেশাকে বিস্তৃত করতে শিক্ষকদের আরো বেশি নৈতিকতার ভিত্তি শক্তিশালী করতে হবে। দেশ ও সমাজ ব্যবস্থার চিন্তা করে নিজেকে বিভিন্ন অপকর্মে না জড়িয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। কারণ একজন আদর্শ শিক্ষক পারে আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে, আদর্শ দেশ গড়ে তুলতে। যদি এর বিপরীত হয় তাহলে প্রশ্ন ওঠে সুমহান পেশায় নিয়োজিত থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য তাদের ভূমিকা কী? তাই তাদের দায়বদ্ধতা থেকে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। কেননা, আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে হলে আদর্শ মানুষ হওয়া জরুরী।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা কলেজ, ঢাকা

Latest Posts

spot_imgspot_img

Don't Miss