আজকে বিশ্ব মা দিবস, তাই আম্মাকে নিয়ে বেশি বলা হবে তা স্বাভাবিক, তবে আমি আমার আব্বা আম্মা দুজনকেই নিয়ে বলবো।
আমার আব্বা খুবই চমৎকার একজন মানুষ, এবং তার সময়ে একজন সেরা মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন কিন্তু তখনকার এলাকার নানাবিধ ঝামেলার কারণে পড়াশোনায় উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারেন নি, যদিও আব্বা পড়াশোনা থেকে বিরতি নেন, কিন্তু নিজের মেধা, ভদ্রতা ও কর্মদক্ষতা এবং সৌন্দর্যে ঠিকই আমার নানা সাহেবের দৃষ্টিতে একজন সুযোগ্য পাত্র হয়েছিলেন।
৭১’ এর মুক্তিযুদ্ধে এবং বিভিন্ন বন্যার প্রকোপে যখন বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পরিবার তাঁদের শান-শওকত মর্যাদা হারিয়ে ভঙ্গুরতায় আশেপাশের নব্য ধনীর তাচ্ছিল্যতায় উপহাস্য,সেই সময় নামকরা শিক্ষিত, মৌলভী, পীর আকছিরুজাম্মান ঠিকই বুঝেছিলেন এই ভঙ্গুরতা চিরস্থায়ী নয়, তাঁদের পরিবর্তন ঘটবে। তাই ‘নানা সাহেব’ মানুষের কুপরামর্শ কে উপেক্ষা করে ঠিকই তার মেয়েকে বিয়ে দিলেন।
আমার নানা সাহেব ভুল করেন নি,আমরা কৃতজ্ঞ যে সেদিন আমার নানা সাহেব তাঁর মেয়ের জন্য একজন বেস্ট পাত্র নির্ধারিত করেছিলেন।
আমার আম্মা এমন একজন নারী যার স্বামী রোড এক্সিডেন্ট করলে পরে আশেপাশের প্রতিবেশী তার পরিচিত আত্মীয় স্বজন পরামর্শ দিয়েছিল যে তাঁকে চিকিৎসা না করাতে, এবং তাঁকে কোনো হাসপাতালে রেখে দিতে, আর ছেলেদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে অন্যের ঘরে কামলা হিসেবে রাখতে।
আমাদের আম্মা তখনকার অল্পশিক্ষায় শিক্ষিত,ঠিকই বুঝেছিলেন শিক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেদিন তিঁনি ঐসব নামেমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনকে তাঁদের পরামর্শের বিপরীতে বলেছিলেন, ” না এটা অন্যায় যে আমার স্বামীকে এই অবস্থায় ছেড়ে দিতে, আমি যদি সতী হই নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার স্বামীকে সুস্থ করে দিবেন,আমি তাঁকে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও সুস্থ করবো,আর বাকি থাকে ছেলেমেয়ের কথা,ওদের পড়াশোনা বন্ধ করাবো না, পড়াশোনাও করাবো, আর ভালোভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থাও করে যাবো।” [ তখন আমার চার ভাইবোন বড় ছিলেন,আর তাঁরা সবাই অলরেডি স্কুলে যেতেন, আর আমিসহ আমরা তিনজন ছোট,এরমধ্যে আমার স্কুলে ভর্তির বয়স ছিল পরের বছর থেকেই]।
মুদ্দাকথায় আসি, আমার আম্মা শেষ পর্যন্ত তাঁর কথা রাখতে পেরেছেন। সব বিপদসংকুল কাটিয়ে তাঁর স্বামীকে সুস্থ করেছেন, আজ আমার আব্বা আবার ব্যবসা বাণিজ্য করে আমাদের বেসিক নিড গুলো মেটান, যদিও এখনো কিছু সেকেলে মাইন্ডের মানুষ আছে যারা আমার আব্বার কর্মঠ হওয়ার বিষয়টাকে সমালোচনা করে- তাঁরা বলে, ছেলেমেয়ে বড় হইছে টাকা পইসা ইনকাম করে, তাছাড়া ওরা ভালোও, তারপরও কেন কাজ করো! বিপরীতে আমার আব্বা তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেন- ” আমার নিজের সম্পদ আমি নিজে রক্ষণাবেক্ষণ করবো না? আমি কি তা পতিত রেখে দিব! ” তাঁরা তখন চুপ ছিল। আমার আব্বার এই জিজ্ঞাসা আমার কাছে সেদিন তাঁকে একজন হিরো বাবাই লাগছিল। অর্থাৎ,তিঁনি সেদিন মানুষের ক্ষুরধার নেতিবাচক মন্তব্য থেকে তাঁর ছেলেমেয়েদের রক্ষা করেছিলেন।
সেইম আমার আম্মা এখনো কাজ করেন, অনেকেই বলেন, এখনো কাজ করেন কেন, জবাবে আমার আব্বার মতোই আম্মা উত্তর দেন এবং তিঁনি সেই দিনের কথা মনে করেন,যেদিন তিঁনি তার স্বামীকে সুস্থ করার জন্য, ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পুত্রের পাশে থেকে,পুত্রকে সাহস দিয়ে,তার কষ্ট লাঘব করার নিমিত্তে সঠিক পাওনা আদায়ের নিমিত্তে ঢাল হিসেবে পাশে থেকেছেন,
তবে এইসব করতে গিয়ে পর্যায়ক্রমে তাঁকে নানা কথা শুনতে হয়েছিল, এমনকি শুনতে হয়েছিল যে — সে মৌলভীর মেয়ে, মৌলভীর বোন, আবার মৌলভীর মা ও, সে কিভাবে পরপুরুষ মাড়িয়ে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাইতে আসে, একজন পীর সাব দিয়ে কেউ একজন এটাও বলিয়েছিল যে- আমার আম্মা যে পরপুরুষ মাড়িয়ে কাজ করেন, আমার আম্মা এজন্য জাহান্নামী ব্যক্তি, আম্মা তখন মানসিক ভাবে ভেঙ্গে এতই পড়েছিলেন, আমি তাঁকে তিন চারদিন এ বিষয় নিয়ে কাঁদতে দেখেছি।
পরবর্তীতে আম্মা মনোবল শক্ত করলেন, এবং তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,তোমরা কেউ আমার স্বামী, সন্তানের দায়িত্ব নাও,আমি ঘরের বাহিরে যাবো না, তখন, কোনো মুর্খ কি মৌলভীও এগিয়ে আসেনি, পরিবারের সম্মৃদ্ধিতে যা করেছেন আমার আম্মা, ভাইয়েরা মিলেই করেছেন।
পর্যায়ক্রমে ভাইয়েরা বড় হলেন, তাঁরা উপার্জন করতে থাকল,তাঁদের উপার্জন বাড়তে থাকল, আমরা বড় হলাম,আব্বা সুস্থ হলেন, অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধি ফিরে এলো,পারিবারিক ঐতিহ্য ফিরে এলো, আমরা সবাই এখন উচ্চ শিক্ষিত, মিলনিয়ার পরিবার আমাদের, যে পরিবারে সাহিত্য চর্চা, পুঁথি পাঠ ছিল প্রতিদিনকার সন্ধ্যারাত কর্ম, বন্ধ হয়ে যাওয়া সেই সাহিত্য কর্ম আবার সাহিত্য চর্চার অঙ্কুর থেকে চারা গজিয়েছে।
আজকের এই সবই একজন বিদুষী মহিলা আমার আম্মার জন্য,সেদিন যদি আব্বাস সুফিয়া দম্পতি যুগল না হতেন, হয়ত আমরা আম্মা পেতাম, কিন্তু আমাদের আম্মা সুফিয়া খাতুনের মতো দৃঢ় মনোবল, সাহসী,অক্লান্ত পরিশ্রমী, বিদুষী, বিজনেসম্যান, স্বামীর প্রতি কর্তব্যপরায়ণ, সন্তানবাৎসল্য মা,পেতাম না। আমি আমার আম্মাকে নিয়ে গর্ব বোধ করি এবং তিঁনিই আমার আর্দশ।
একজন লেখক হিসেবে, আমি একজন পুরুষের জন্য চাই আমার মায়ের মতো স্বামীপরায়ণ, স্ত্রী আর সন্তানদের জন্য নিবেদিত,পরিশ্রমী সন্তানবাৎসল্য মা।
যাহোক, অনেক কথা বললাম, আজকের মা দিবসে, জানি আমার মায়ের মতো লাখো কোটি মা আছেন যারা তাঁর স্বামী এবং সন্তানদের জন্য এইরকম নিরবে নিভৃতে নানা মানুষের আকথা, কুকথা উপেক্ষা করে পরিশ্রম করে যান,সেইসব বিদুষী মায়েদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। আমি সকলের মা বাবার জন্য দোয়া করি। এবং আমার মা বাবার জন্য দোয়া প্রার্থী।
হামিদা আব্বাসী
ঔপন্যাসিক ও গল্পকার