আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগে যখন ব্যাঙ্গালোর আসি, সেই প্রথম আমার নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্য কোথাও পাড়ি দেওয়া। ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখছিলাম দাক্ষিণাত্যের রুক্ষ পাথুরে মাটি বিছানো ছোট ছোট স্টেশন, সেখানে গোলাপি সাদা কাগজফুলের গাছ ভরে ফুল এসেছে। স্টেশনচত্বর বিছিয়ে পড়ে আছে সেই কাগজফুলের পাপড়ি । প্ল্যাটফর্মের অনতিদূরেই অনুচ্চ পাহাড়ের সারি, আনারস গাছের মত কী এক নাম না জানা গাছ ছেয়ে ফেলেছে পাহাড়ের পাদদেশ। কোনো কোনো পাহাড়ের উপরে ছোট্ট এক মন্দির । সন্ধ্যে ঘনালে দেখতাম, টুকটাক ছোট্ট ছোট্ট আলো জ্বলে উঠছে সেই পাহাড়ের এদিকে ওদিকে। রাত বাড়লে, কামরার সব আলো যখন নিভে যেত, যখন কামরাভর্তি মানুষের গুঞ্জন সহসা নিঝুম হয়ে আসতো, সাইড লোয়ারের জানলার ধারে বসে পাহাড়গুলোর দিকে তাকালে মনে হত, আকাশের তারারা যেন হঠাৎ পথ ভুলে নেমে এসেছে সেই পাহাড়ের গায়ে। আমি একা বসে ভাবতাম, ওই রাতে পাহাড়ের কোলে কোনো পাতায় ছাওয়া বাড়িতে বসে হয়তো একটেরে রান্নাঘরে রুটি সেঁকছে কেউ । সারাদিনের কাজের পর বাড়ি ফিরে ঘরের দাওয়ায় বসে মিছরি ভেজানো জলের ঘটিতে চুমুক দিয়ে ক্লান্তি মুছে ফেলছে কেউ । দূরে তাকালে তাদেরও চোখে পড়বে আমাদের ট্রেনটা । ওই অন্ধকার পাহাড়ের ঢালে ঘর বেঁধে থাকা মানুষদেরও কী তখন আমাদের রেলগাড়িটাকে হগওয়ার্টস এক্সপ্রেসের মতো অলীক মনে হবে?
সেই বার আমার কুপের বাকি বার্থগুলোতে আমার সাথে ট্রাভেল করছিলেন একটি বাঙালি পরিবারের কয়েকজন । তারা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার এসেছেন দাক্ষিণাত্যে । আমি প্রথম বার আসছি শুনে তারা আমাকে বলেছিলেন, দেখবে ব্যাঙ্গালোরের পাড়াগুলো আমাদের পাড়ার চাইতে বেশ আলাদা । মাছওয়ালা, সবজিওয়ালার হাঁক ডাক নেই, চায়ের দোকানে অলস আড্ডা নেই, মাছ মাংস রান্নার আঁশটে গন্ধ নেই, বিড়াল কুকুরের উৎপাত নেই, ঘরগুলো থেকে যখন তখন ভেসে আসে চন্দন ধূপ, ফুলের সুগন্ধ, কারিপাতার সুবাস । তারা প্রশংসা করেই বলেছিলেন বটে, কিন্তু আমার খুব দমবন্ধ লাগছিল। নিজের শৈশব কৈশোরের পরিচিত কিছুই নেই এমন একটা শহরে কী ভাবে থাকব আমি?
ব্যাঙ্গালোর এসে দেখলাম, ওঁদের কথা আংশিক সত্যি । এখানেও মানুষ দিনের শেষে বেকারিতে দাঁড়িয়ে লেবু চায় গলা ভিজিয়ে এগ পাফে কামড় দেয় । রাস্তায় লালু ভুলুরা যথেষ্টই আছে এবং তারা খুবই আদরপ্রিয় ও কেয়ারিং । তবে হ্যাঁ মাছ মাংস খাওয়া নিয়ে বাছ বিচার যথেষ্ট । সে ভাবে দেখতে গেলে এই পার্থক্যগুলোই হয়তো আমাদের দেশকে এত বৈচিত্রময় করেছে । আমাদের গাঁ মফস্বলের বাড়ির আশেপাশে ঘি গরম মশলার গন্ধ, আদা মৌরি বাটার ফোড়নের সুবাস, সর্ষে তেলের ঝাঁজ এখানকার সর্ষে, ডাল, কারিপাতার গন্ধের চেয়ে আলাদা কিন্তু সেও কী কম সুন্দর?
বছর চারেক আগে কোভিড হওয়ার ঠিক আগের সময়টায় আমি অফিসের একটি কাজে চেন্নাই গিয়েছিলাম দিন পনেরোর জন্য। ছিলাম অফিসেরই গেস্ট হাউজে। সেখানে কিচেনের তত্বাবধানে ছিলেন মেদিনীপুরের বাঙালি মন্টুদা। গেস্ট হাউজে যেহেতু দক্ষিণী গেস্টই বেশি, তাই সারা সপ্তাহ সেখানে দক্ষিণী রান্নাই হত। শনিবার সকাল সকাল উঠে মন্টুদা মাছ বাজারে যেতেন। বাজার করে আনতেন রুই, কাতলা, আরও অনেক ছোট ছোট সামুদ্রিক মাছ। কিচেন লাগোয়া লম্বা টানা বারান্দায় বসে শিল পেতে সর্ষে কাঁচা লঙ্কা বেটে তাই দিয়ে ঝাল ঝাল গা মাখা রান্না করতেন মাছের । কোনো মাছ আবার ঝিরি করে পেঁয়াজ কেটে, টমেটো দিয়ে ঝোল। শেষ পাতে টমেটো খেজুরের চাটনি। চেন্নাইয়ের শান্ত শেনয় নগর তখন আমাদের পরিচিত শহরতলীর মতো মেছো গন্ধে ম ম করত। মনে হত, এই তো বাড়িতেই আছি।
যাযাবর মানুষরা যেখানে যায়, সেখানেই বুঝি নিজের সাথে এক টুকরো শিকড় নিয়ে যায় । আজ যখন ব্যাঙ্গালোরের এই নির্জন পাড়ায় দুপুরবেলা মাংস রাঁধব বলে গোটা মশলা চাটুতে সেঁকে গুঁড়ো করছিলাম, তার সুগন্ধে মনে পড়ছিল, আমাদের গ্রামের বাড়ির হেঁসেলে মা ঠিক এমন করেই রান্না করত । সুগন্ধে মাত হয়ে থাকত পুকুর পাড়, গুলঞ্চ গাছের ঝোপ, শিউলি তলা। আজ সেই একই সুগন্ধ ভেসে আছে ব্যাঙ্গালোরের পাড়াতে । টরন্টোর যে নিঝুম পাড়ায় দুপুরবেলা আমার বাঙালি রান্নার গন্ধ ব্যাক ইয়ার্ডের চেরি ট্রিটাকে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলে, তখন কী ভাবে যেন দেশ কালের তফাৎ ঘুচে যায় । কোথাও গিয়ে এক হয়ে যায়, ধান ক্ষেতে পাশে পুকুর ঘেঁষে সেই রান্নাঘরটা, নিম গাছের ছায়া পেরিয়ে রোদ ঝাঁপিয়ে আসা এই বাড়িটা আর আমার টরন্টোর ওই শান্ত পাড়ার হাই এন্ড কিচেনটা । আমরা সবাই ছিলাম, আছি – এই এক আকাশের নিচে। জীবন সুন্দর। আহা জীবন।
(লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া লেখটি)
চস/আজহার