অনেক আশা এবং সম্ভাবনা নিয়ে এবারের বিশ্বকাপ মঞ্চে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। শুরুটা হয় বেশ চমৎকার। প্রথম ম্যাচেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুর্দান্ত জয়ে আসরে ভালো কিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছিল মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। কিন্তু বিশ্বকাপের শেষটায় আক্ষেপ ছিলো বেশি। আসরে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ব্যবধান ছিলো অনেক। সেমিফাইনালের স্বপ্নভঙ্গের পর ৪ ম্যাচ জিতে এবারের বিশ্বকাপকে নিজেদের ইতিহাস সেরা করার লক্ষ্যও পূর্ণ করতে পারেনি টাইগাররা। আসরে ১০ দলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান টেবিলে ৮ নম্বরে। টুর্নামেন্টের আগে র্যাঙ্কিংয়ের ৭ নম্বর দল হিসেবেই খেলতে এসেছিল বাংলাদেশ। ফিরছে সেই একই অবস্থানে থেকে। টাইগাররা টুর্নামেন্ট শেষ করেছে ৩ জয় ও ৫ হারে। বৃষ্টিতে বাতিল একটি ম্যাচ। আসরে ভালোমন্দ দুই সময়ই দেখেছে বাংলাদেশ।
এবারের বিশ্বকাপ দলকে ঘিরে অনেক স্বপ্নই বুনেছিলেন টাইগার-ভক্তরা। আর স্বপ্ন দেখতেই পারে। কারণ গত বিশ্বকাপ থেকে টানা ৪ বছরের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দেখলে যেকউ বাংলাদেশ দল নিয়ে আশাবাদী থাকবে। ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা বাংলাদেশ ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালেও ওঠে। আন্তর্জাতিক আসরে যেটি টাইগারদের সবচেয়ে বড় সাফল্য। ২০১৬ ও ২০১৮ টানা দুটি এশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। এছাড়া গত বছর দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের পর শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল খেলার সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরেই দেশের মাটিতে একের পর এক সিরিজ জয়ের সাফল্যে মেতেছে টাইগাররা। সর্বশেষ আয়ারল্যান্ডের মাটিতে প্রথমবারের মতো বহুজাতিক আসরে শিরোপা জিতেই বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে টাইগাররা। একের পর এক সাফল্যের পথ পাড়ি দিয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। দলের সামর্থ্যে, অর্জন এসব দেখে আস্থা বেড়েছে টাইগার-সমর্থকদেরও। তারা স্বপ্ন দেখেছেন, বিশ্বাস করেছেন ‘পঞ্চপান্ডব’ তথা পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটার এবং মোস্তাফিজ, সৌম্য, সাইফউদ্দিন, লিটনদের মতো একঝাঁক তরুণকে নিয়ে গড়া দল ইতিহাসের সেরা সাফল্য নিয়েই বিশ্বকাপ থেকে ফিরবে। কিন্তু সমর্থকদের আস্থার সেই প্রতিদান দিতে পারেনি মাশরাফি বাহিনী। দারুণ কিছু ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সই এ বিশ্বকাপে টাইগার দলের মূল প্রাপ্তি। তবে দলীয় প্রাপ্তির খাতা যে একেবারে শূন্য তা নয়।
এবারের বিশ্বকাপে দুইবার নিজেদের সর্বোচ্চ ওয়ানডের রানের স্কোর গড়েছে বাংলাদেশ। ওভালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে বিশ্বকাপ ও ওয়ানডেতে নিজেদের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। ৩৩০ রানের স্কোর গড়ে টাইগার বাহিনী পায় ২১ রানের অসাধারণ জয়। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৩২১ রান সফলভাবে তাড়া করে বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড গড়ে মাশরাফি বাহিনী। এ ম্যাচে ৭ উইকেটে জেতে টাইগাররা। পরের ম্যাচে নটিংহ্যামে অস্ট্রেলিয়ার ‘এভারেস্ট’সম ৩৮১ তাড়া করতে নেমে ৮ উইকেটে ৩৩৩ করে আবারও নিজেদের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়ার কৃতিত্ব দেখায় বাংলাদেশ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৬৬ রানের জয়ের পর ভারতের বিপক্ষেও দুর্দান্ত লড়াই করে বাংলাদেশ। এ ম্যাচে ২৮ রানে হেরে সেমিফাইনাল স্বপ্নের অবসান ঘটলেও ম্যাচে মোস্তাফিজের বোলিং ঝলকের পর সাব্বির রহমান ও সাইফউদ্দিনের ব্যাটিং বীরত্ব স্মরণীয় হয়ে থাকবে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে মাত্র ২ উইকেটে হেরে যায় বাংলাদেশ। তবে টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ড ও পাকিস্তানের বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচটিতেই বাজে পারফরম্যান্স দেখায় টাইগার দল। ইংলিশদের কাছে ১০৪ রানের হারের পর পাকিস্তানের কাছে ৯৪ রানে হারে বাংলাদেশ। পাকিস্তানকে হারালে পয়েন্ট তালিকার পাঁচে থাকার সুযোগ থাকত। সেটি করতে না পারায় টাইগারদের বিশ্বকাপ মিশনকে সফলও বলা যাচ্ছে না।
চলতি বিশ্বকাপের আগে ২০০৭, ২০১১ ও ২০১৫ বিশ্বকাপেও তিনটি করে ম্যাচ জিতেছিল বাংলাদেশ। তবে ২০০৭ সালের সাফল্যে কাঁটা হয়ে আছে আয়ারল্যান্ডের কাছে হার, ২০১১ সালে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৮ রানে অলআউট হওয়ার যন্ত্রণা। ২০১৫ বিশ্বকাপে তিন জয়ের দুটি ছিল স্কটল্যান্ড ও আফগানিস্তানের মতো দুর্বল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে। এবার সেদিক থেকে পুরো টুর্নামেন্ট বিচার করলে হয়তো বাংলাদেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক বিশ্বকাপ। তবে দলীয় সাফল্যে মন না ভরলেও এবারের আসরে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে টাইগার সমর্থকদের মন ভরিয়েছেন সাকিব আল হাসান ও মোস্তাফিজুর রহমান। সাকিব ব্যাটে-বলে বাংলাদেশের তো বটেই, এবারের বিশ্বকাপের এখন পর্যন্ত সেরা পারফরমার। ৮ ম্যাচে সাকিবের সর্বনিম্ন স্কোর ৪১ রান বলে দিচ্ছে কতটা স্বপ্নের সময় কাটিয়েছেন। দুটি সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫টি ফিফটি করেছেন। বল হাতেও বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে প্রথমবার পেয়েছেন ৫ উইকেট। ৮ ম্যাচে ৬০৬ রান করে সাকিব কিংবদন্তিদের ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সাকিবের চেয়ে এক আসরে বেশি রান পেয়েছেন শুধু শচীন টেন্ডুলকার ও ম্যাথু হেইডেন। তবে ব্যাটিংয়ের সঙ্গে বোলিং পারফরম্যান্স বিবেচনায় নিলে বিশ্বকাপ ইতিহাসে সেরা অলরাউন্ডার সাকিব। এক বিশ্বকাপে ৫০০-এর বেশি রানের সঙ্গে ১০-এর বেশি উইকেট আর কোনো ক্রিকেটারের নেই। বাংলাদেশ আসরে শেষ চারে উঠলে নিশ্চিতভাবেই টুর্নামেন্টসেরা হতেন। এখনও অবশ্য সাকিব টুর্নামেন্টসেরা না হলে সেটা তার জন্য খানিকটা দুর্ভাগ্যেরই হবে। এবারের আসরেই সাকিব গড়েছেন সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে ৫০০০ রান ও ২৫০ উইকেটের রেকর্ড। মোস্তাফিজ ৮ ম্যাচে ২০ উইকেট নিয়ে এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা বোলার। ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা দুই ম্যাচে নিয়েছেন ৫টি করে উইকেট। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তো বটেই, বিশ্বকাপে এক আসরে মোস্তাফিজের চেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার কীর্তি আছে আর মাত্র ১২টি।
তাই দলীয় অর্জন কম হলেও ব্যক্তিগত অর্জন ছিলো দেখার মতো। তবুও দল না জিতলে এসব ব্যক্তিগত অর্জন নিয়েও সুখ পান না খেলোয়াড় এবং সর্মথকরা। তাই বাংলাদেশ জিততে হলে প্রয়োজন দলীয় পারফরম্যন্স। দলের সকলে ভালো খেললে অবশ্যই দল জিতবে। একা সাকিব কিংবা মুস্তফিজের মাধ্যমে কখনও বাংরাদেশ দল ভালো পর্যায়ে যেতে পারবে না। বড়জোর দুয়েকটি খেলা জিততে পারে। এবার সবচেয়ে বেশি আশাহত করেছেন তামিম ইকবাল। সেইসাথে মাশরাফি এবং রুবেলও। আস্থার প্রতিদান ঠিকভাবে দিতে পারে নি সাব্বির এবং মিরাজ। তাদের পারফরম্যান্সে ছিলো ঘাটতি। এরা জ্বলে উঠলে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সেমি ফাইনাল খেলতো এটা সন্দেহ করার কেউ ছিলো না। যাইহোক এবার বাংলাদেশের সর্মথক এবং ক্রিকেটপ্রেমিরা ২০২৩ সালের আঁশায় বুক বাধঁতে পারে। কারণ ক্রিকেট বাংলাদেশের আবেগ। তাই এটা আমাদের হৃদয়ে সবসময় থাকেব। আর তাই ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন প্রতিদিনই দেখবে বাংলাদেশের সর্মথকরা। একদিন আমরা জিতবই।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট