জাফলংয়ের সৌন্দর্যে মজেনি এমন মানুষ এর সংখ্যা খুবই কম। জাফলংয়ের নদী পার হলেই যে পাড়া পাওয়া যায় তার নাম খাসিয়াপুঞ্জি। পাড়ায় বসবাসকারীরা সবাই খাসিয়া। খাসিয়াদের প্রতি বাড়ি ঘিরেই রয়েছে পানবরজ। মাতৃপ্রধান খাসিয়া সম্প্রদায়ের পুরুষরা গাছ বেয়ে বরজ থেকে পানপাতা সংগ্রহ করেন। বাড়ির উঠানে বসে নারী সদস্যরা পানপাতা ভাঁজ করে খাঁচা ভর্তি করেন বিক্রির জন্য। পানপাতা সংগ্রহ ও খাঁচা ভর্তি করার অভিনব দৃশ্য পর্যটকদের নজর কাড়ে। বরজ ছাড়াও খাসিয়াপল্লীতে দেখা যাবে কমলা বাগান। কাঁচা-পাকা কমলায় নুয়ে আছে বাগানের গাছ। সংগ্রামপুঞ্জির রাস্তা ধরে আরেকটু এগুলো দেখা যাবে দেশের প্রথম সমতল চা বাগান।
সংগ্রামপুঞ্জির মায়াবী ঝরনা
সংগ্রামপুঞ্জির মায়াবী ঝরনা সম্প্রতি নজরে এসেছে দর্শনার্থীদের। কেউ কেউ একে সংগ্রামপুঞ্জি ঝরনাও বলে থাকেন। জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ১৫-২০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে। ভারত সীমান্তের এ ঝরনা বিএসএফের প্রহরায় বাংলাদেশীরা চূড়া পর্যন্ত উঠতে পারেন। কয়েক ধাপবিশিষ্ট এমন ঝরনা কমই দেখতে পাওয়া যায়। খানিকটা দূর থেকেই ঝরনার মেঘালয়ের পাহাড় বেয়ে বয়ে যাওয়ার গর্জন কানে আসবে। সামনে যেতেই চোখে পড়বে গাছ, পাথর আর পানির অপূর্ব মেলবন্ধন। পাহাড়ের গা-বেয়ে বেশ কয়েকটি ধারায় নেমে আসছে ফেনিল সাদা পানির স্রোত। কখনো সবুজ ঝোপের ভেতর দিয়ে, কখনোবা নগ্ন পাথরের বুক চিরে নেমে আসে এ পানি। ঝরনার জল এসে জমা হয়ে ছোট্ট পুকুরের মতো সৃষ্টি হয়েছে, যার তিনদিকেই রয়েছে বড় বড় পাথরের চাই। চাইলে সেই শীতল জলে ডুব দিতে পারেন। ঝরনার তৃতীয় ধাপ থেকে কিছু পানি নিচে গড়িয়ে পড়ে, কিছু চলে যায় বামদিকের সুড়ঙ্গে। সুড়ঙ্গমুখের কিছুটা অংশ পর্যন্ত দৃষ্টি চলে, বাকিটা অন্ধকার।
পাংথুমাই ঝরনা
এবার খাসিয়াদের বাজার সংগ্রামপুঞ্জিতে। এই বাজার থেকে পাংথুমাই প্রায় ১০ কিলোমিটার। সংগ্রামপুঞ্জি থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে হাজিপুর বাজার। সে পর্যন্ত যানবাহন চলে। পরে মোটরসাইকেল আর শ্যালোইঞ্জিনচালিত ভটভটিতে। সংগ্রামপুঞ্জির পরেনকশিয়ার পুঞ্জি, পুরো অঞ্চলটিই ঘন সুপারি বাগান আর পানগাছে ভরপুর। সরুপথের দুধারে খাসিয়াদের সুন্দর বাড়িঘর। পাহাড়ি স্বচ্ছ জলের ছড়া পাড়ি দিয়ে গাঁয়ের মেঠোপথ, বাঁশবাগান, হাঁটুজলের নদী পার হয়ে প্রতাপপুর গ্রাম। এর পরের গ্রাম পাংথুমাই। প্রতাপপুর গ্রাম পাড়ি দিয়ে সামনে উঁচু পাহাড়ঘেঁষে বিশালাকার এক ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে হালকা জঙ্গল পেরিয়েই শোনা যাবে জল কলকল শব্দ। জঙ্গলের মাঝখানে উঁকি দেয়া এটাই রূপবতী ঝরনা পাংথুমাই। স্থানীয়রা ঝরনাটিকে ফাটাছড়ি বা বড়হিল ঝরনাও বলেন।
সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাটের পশ্চিম জাফলং ইউপির একটি গ্রাম পাংথুমাই। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খড়স্রোতা পিয়াইন নদী। পাশের দেশ ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সুউচ্চ পাহাড় যেন পাংথুমাই গ্রামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। পিয়াইন নদীর মূল জলধারা এই মেঘালয়ের ঝরনাগুলো থেকেই সৃষ্ট। মেঘালয় রাজ্যের ইস্ট খাসিয়া হিল জেলার পাইনেচুলা থানার অন্তর্গত পাহাড়ি ঝরনা বপহিল।
একটু দূরে বিএসএফের ক্যাম্প। বরইগাছের সারি দিয়ে এখানে দুই দেশের সীমানা ভাগ করা। এখানে বিজিবির কোনো চৌকি নেই। ঝরনা ভারতের হলে, পানি এসে পড়ছে আমাদের দেশে, রূপ নিয়েছে নদীর। শীতল আর কাচের মতো পরিষ্কার পানি সৃষ্টি করেছে একখণ্ড স্বর্গ টুকরো।
মায়াবী ঝরনা ও পাংথুমাই ঝরনা দুটোই ভারতের! কিন্তু উপভোগ করছি আমরা। তাও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই!
কীভাবে যেতে হবে
সিলেট শহর হতে ৫৬ কিলোমিটার দূরে পাথরের স্বর্গ জাফলং অবস্থিত। প্রথমে সিলেটে আসতে হবে। বাস-ট্রেন বা বিমানপথে সিলেটে যাওয়া যায়। সড়ক, রেল ও আকাশপথে ঢাকা থেকে সরাসরি সিলেট যেতে পারেন। চট্টগ্রাম থেকেও সিলেটে যাওয়া যায়। ঢাকার ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাসস্টেশন থেকে সিলেটের বাসগুলো ছাড়ে। ভাড়া ৮০০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা। সিলেট নগরী থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত জাফলংয়ে বাস, মাইক্রোবাস, অটোরিকশা বা লেগুনায় যাওয়া যায়। এজন্য লোকাল বাসে ভাড়া পড়বে ৬৫ টাকা। আর রিজার্ভ মাইক্রোবাস ভাড়া করতে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা গুনতে হবে।
থাকা ও খাওয়া
সিলেটজুড়ে ও জাফলংয়ে বিভিন্ন দাম-মানের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
চস/ সোহাগ